সাত
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মত মর্মান্তিক ঘটনা, আর দ্বিতীয় ঘটেনি। মন্বন্তর বাঙলা দেশকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করেছিল যে পরবর্তী কালে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাঙলার লোকের কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নরূপ কিংবদন্তীতে দাঁড়িয়েছিল। সমসাময়িক দলিলসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত নিজ অনুশীলনের ভিত্তিতে লিখিত ডবলিউ. ডবলিউ. হাণ্টার তার ‘অ্যানালস অভ্যু রুরাল বেঙ্গল’ বইতে এর এক বিশ্বস্ত বিবরণ দিয়েছেন। হাণ্টারের বর্ণনা—‘১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে গ্রীষ্মকালে রৌদ্রের প্রবল উত্তাপে মানুষ মরিতে লাগিল। কৃষক?” গরু বেচিল, লাঙ্গল-জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, তারপর ছেলেমেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ক্রেতা নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল। ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল। তারপর মৃতের মাংস খাইতে লাগিল। সারাদিন সারারাত্র অভুক্ত ও ব্যাধিগ্রন্ত মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ছুটিল। তারপর মহামারী দেখা দিল। লোকে বসন্তে মরিতে লাগিল। মুরশিদাবাদের নবাবপ্রাসাদও বাদ গেল না। বসন্তে নবাবজাদা সইফুজের মৃত্যু ঘটিল। রাস্তায় মৃত ও নির্ধনীর শবে পূর্ণ হয়ে পাহাড়ে পরিণত হইল। শৃগাল কুকুরের মেলা বসিয়া গেল। যাহারা বাচিয়া রহিল, তাহাদের পক্ষে বাঁচিয়া থাকাও অসম্ভ হইয়া দাঁড়াইল।‘ অনুরূপ বর্ণনা বঙ্কিমও তাঁর ‘আনন্দমঠ’-এ দিয়েছেন। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘১১৭৬ সালে গ্ৰীষ্মকালে একদিন পদচিকু গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। … সম্মুখে মন্বন্তর …লোক রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু বেচিল, লাঙ্গল বেচিল, জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রীকে কেনে খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল, যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্ৰাণত্যাগ করিল। বসন্তের বড় প্ৰাদুৰ্ভাব হইল, গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল।‘
লর্ড মেকলেও তাঁর বর্ণাঢ্য ভাষায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এক করুণ চিত্র দিয়েছেন–
“In the summer of 1770 the rains failed; the earth was parched up; and a famine, such as is known only in the countries where every household depends for support on its own little patch of cultivation filled the whole valley of the Ganges with misery and death. Tender and delicate women, whose veils had never been lifted before the public gaze, came forth from their inner chambers in which Eastern zealousy had kept watch over their beauty, threw themselves on the earth before the passerby, and, with loud wailings, implored a handful of rice for their children. The Hooghly everyday rolled down thousands of corpses close to th portieos and gardens of the Englisn conquerors. I ne very streets or Valcutta were blocked up by the dying and dead. The lean and feeble survivors had not energy enough to bear the bodies of their kindred to the funeral pile or to the holy river or even to scare away jackals and vultures who fed on human remains in the face of the day . . . It was rumoured that the Company’s servants had created the famine by engrossing all the rice of the country”. (Macaulay in essay on “Clive” quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengal” 1963, pages 177-178)
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটেছিল অনাবৃষ্টির জন্য। তার আগের বছরেও বৃষ্টির স্বল্পতার জন্য ফসল কম হয়েছিল। তার জন্য চাউল মহার্ঘ্য হয়েছিল। কিন্তু লোক না খেয়ে মরেনি। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় লোক না খেয়ে, মরেছিল। তার কারণ, যা চাউল বাজারে ছিল, তা কোম্পানি আকালের আশঙ্কায় সিপাইদের জন্য বাজার থেকে কিনে নিয়েছিল। কোম্পানি যখন চাউল কিনতে শুরু করল, তখন তারই পদাঙ্কে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে যারা গোপন ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকত, তারাও লাভের প্রত্যাশায় চাউল কিনে মজুত করল। সমসাময়িক এক বৰ্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে কোম্পানির যে কর্মচারীর এক বৎসর পূর্বে ১০০ পাউণ্ডেরও সংস্থান ছিল না, পর বৎসর সে, ৬০,০০০ পাউণ্ড দেশে পাঠাল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রকোপে বাঙলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গিয়েছিল। আর কৃষকদের মধ্যে মারা গিয়েছিল শতকরা ৫০ জন। জনবহুল গ্রামসমূহ জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। বীরভূমের বহু গ্রাম এমন জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল যে এই ঘটনার দশ বছর পরেও সৈন্যদের পক্ষে সে সকল স্থান অতিক্রম করা সম্পূর্ণভাবে দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এত কৃষক মরে গিয়েছিল যে মন্বন্তরের পর নিজ নিজ জমিতে চাষী বসাবার জন্য জমিদারদের মধ্যে এক প্ৰতিদ্বন্দিতা ঘটেছিল। তখন থেকেই বাঙলা দেশে খোদবন্ত রায়ত অপেক্ষা পাইকন্ত রায়তের সংখ্যা বেড়ে যায়।