ক্লাইভ সৈন্যবিভাগেরও সংস্কার করেন। সৈন্যবিভাগে তিনি যুগল-বাট্টা প্রণালী রহিত করেন। সৈন্যবাহিনীর গঠনেরও তিনি পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি সৈন্যবিভাগকে তিনটি ব্রিগেডে বিভক্ত করেন। প্ৰত্যেক ব্রিগেড়ে থাকে একদল ইংরেজ পদাতিক, একদল গোলন্দাজ, ছয়দল এদেশী সিপাহী ও একদল এদেশী অশ্বারোহী সৈন্য। মারাঠাদের আক্রমণ প্ৰতিহত করবার জন্য এই তিনটি ব্রিগেডকে তিনি যথাক্রমে মুঙ্গের, বঁকিপুর ও আলাহাবাদে অবস্থিত করান। অযোধ্যার নবাব ও সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে তিনি এক বন্দোবস্ত করেন। এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী ২৬ লক্ষ টাকা বার্ষিক বৃত্তি প্ৰদানের পরিবর্তে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী (রাজস্ব শাসন) সংগ্ৰহ করেন। দেওয়ানী লাভের ফলে এখন থেকে ইংরেজরাই এই তিন প্রদেশের রাজস্ব আদায় করবে, সম্রাট মাত্র একটা বার্ষিক বৃত্তি পাবেন। এর ফলে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে নিজামত (যা ইংরেজরা নবাব নজম-উদ-দৌল্লার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল) ও দেওয়ানী, এ দুই-ই ইংরেজদের হাতে এসে পড়ে, এবং তারাই এদেশের প্রকৃত শাসক হয়ে দাঁড়ায়।
দেওয়ানী লাভের পর আরও সাত বছর পর্যন্ত আগেকার ভূমিরাজস্ব প্ৰশাসনই বলবৎ থাকে। (পরে দেখুন) এবং কোম্পানির নায়েব-দেওয়ানরূপে মহম্মদ রেজা খা বাঙলার ভূমিরাজস্বের পরিচালনা করতে থাকেন। এর ফলে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয় (নীচে দেখুন)। কিন্তু অত্যধিক রাজস্ব দাবী, বাৎসরিক ইজারা দান ইত্যাদির ফলে দেশের মধ্যে এক স্বৈরতান্ত্রিক অরাজকতার আবির্ভাব ঘটে।
ছয়
দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজরাই যে প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধীশ্বর হলেন, এটা অন্যান্য ইওরোপীয় জাতিগণের কাছে গোপন রাখবার জন্য, ক্লাইভ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্ৰহণ করেন নি। নবাবই দেশশাসন করছেন, এটা বাহত দেখাবার জন্যই তিনি নবাবের নিযুক্ত দুই পূর্বতন প্ৰতিভুকে-মুরশিদাবাদে মহম্মদ রেজা খান ও পাটনায় রাজা সিতাব রায়কেতাদের রাজস্ব আদায়ের কাজে বহাল রাখেন। তারাই রাজস্ব আদায় করবে, মাত্র রাজস্ব আদায়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা পাবে, এরূপ স্থিরীকৃত হয়। এর ফলে দেশের মধ্যে দ্বৈতশাসনের প্রবর্তন হয়। কিন্তু দ্বৈতশাসন হয়ে দাঁড়ায় প্ৰজাপীড়ন ও নির্মম অত্যাচারের এক যন্ত্র। এ সম্পর্কে দেবীসিংহ-এর অমানুষিক অত্যাচার বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। দেবীসিংহ ছিলেন পাঞ্জাবের লোক। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ তিনি বাঙলা দেশে আসেন। মহম্মদ রেজা খাঁ তাকে পূৰ্ণিয়ার ইজারাদার করেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য দেবীসিংহ কোন রকম অত্যাচার, অবিচার ও অন্যায় করতে দ্বিধা করত না, তার অত্যাচার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম কারণ। ১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে সে বেনামীতে রঙপুর, দিনাজপুর ও এন্দরাকপুর ইজারা নেয়। ইটাকুমারীর রাজা শিবচন্দ্র রায়ের ওপর সে অমানুষিক অত্যাচার করে। তাঁর শোষণের ফলে ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে রঙপুরের জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল নুরুলুদ্দিন। তিনি নিজেকে ‘নবাব’ ঘোষণা করেন ও দয়াশীল নামে এক প্ৰবীণ কৃষককে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত করে দেবীসিংহকে কর না দেবার আদেশ জারি করেন। তাঁর অনুচররা দেবীসিংহ ও ইংরেজদের ঘাঁটি মোগলহাট বন্দরের ওপর আক্রমণ চালায়। এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে নুরুলুদ্দিন জখম ও বন্দী হন ও কয়েক দিন পরে মারা যান।
দেবীসিংহের বিরুদ্ধে প্ৰকাশ্য বিচার হয়। কিন্তু প্ৰমাণাভাবে সে মুক্তি পায়। এই দেবীসিংহই নসীপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দে ক্লাইভ বিলাতে ফিরে যান। সেই সময় থেকে ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেষ্টিংসের নিয়োগ পৰ্যন্ত ভারতে ইংরেজদের বিষয়-ব্যাপার ভেরেলস্ট ও কাটিয়ারের হাতে ছিল। তাদের শাসনকালে দেশের মধ্যে দুর্নীতির আবার পুনঃ প্ৰকোপ হয়, যার ফলে দেশ ধ্বংসের পথে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে। রিচার্ড বেচার নামে কোম্পানির একজন কর্মচারী ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই পরিস্থিতি সম্বন্ধে কোর্ট অভ ডিরেকটরসদের এক গোপন কমিটির কাছে লিখে পাঠান—“It must give pain to an Englishnan to have reason to think that since the accession of the Company to the Diwani, the condition of the people of the country has been worse than it was before; and yet I am afraid the fact is undoubted the fine country which flourished under the most despotic and arbitrary government, is verging towards ruin… when the English received the grant of the Diwani, their consideration seems to have been the raising of as large sums from the country as could be collected to answer the pressing demands from home and to defray large expenses here.” (Richard Becher’s letter to the Select Committee of the Directors in 1769 quoted in A. K. Sur’s “History & Culture of Bengal” 1963; page 177)
বেচারের চিঠির ভিত্তিতে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে এদেশী কর্মচারীদের ওপর নজর রাখবার জন্য সুপারভাইজার অভ্ রেভেন্যু নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এরই পদাঙ্কে বাঙলায় আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।