।। তিন ।।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাঙলার ভূ-প্রকৃতি মোটামুটিভাবে এখনকার মতই ছিল, তবে অন্তবর্তীকালে জনবিন্যাসের অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বাঙলার বিচিত্র ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য এই যে পশ্চিমে বিন্ধ্যপর্বতের পাদমূল থেকে এক তরঙ্গায়িত মালভূমি পূর্বদিকে এগিয়ে এসেছে ভাগীরথী-জাত পলিমাটির দেশের দিকে। পশ্চিমের এই অংশ বনজঙ্গল পরিবৃত রুক্ষ ও কর্কশ শাশ্বত নির্জনতায় মণ্ডিত ৷ শৈল অন্তরীপরূপে এই মালভূমি অভিক্ষিপ্ত হয়েছে মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল পর্যন্ত। এই অঞ্চলের শাশ্বত নির্জনতার মধ্যেই অভ্যুত্থান ঘটেছিল তন্ত্রধর্মের। অতি প্ৰাচীনকাল হতে এই অঞ্চলে বাস করে এসেছে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসীরা যথা সাঁওতাল, লোধা, হো প্ৰভৃতি ।
পূর্বদিকে এই ভূখণ্ডই মিশে গিয়েছে কোমল পলিমাটির দেশের দিকে। শস্যশ্যামলা এই পলিমাটির দেশই বাঙলার ঋদ্ধির আকর। এখানেই উৎপন্ন হত ধান্য, তুলা, রেশম, ইক্ষু, সরিষা প্ৰভৃতি তৈলবীজ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসব কৃষিপণ্য বাঙলাদেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত। এ সব পণ্যই বাঙলার কৃষকের সমৃদ্ধির কারণ ছিল। পরে বাঙালীর এই কৃষি-বনিয়াদের আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল, যার পরিণামে আজ আমাদের ইক্ষু ও সরিষার জন্য বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। তুলার চাষের পরিবর্তে এখন পাটের চাষ হয়, যার ন্যায্য মূল্য বাঙালী কৃষক পায় না ; কিন্তু যার মুনাফার সিংহভাগ অবাঙালীর উদর স্ফীত করে ।
কৃষি ব্যতীত অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রাম বাঙলার সমৃদ্ধির উৎস ছিল, নানারূপ শিল্প। অর্থনীতির দিক দিয়ে গ্রামগুলি ছিল স্বয়ম্ভর । গ্রামের লোকের দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্ৰীসমূহ ও পালপার্বণে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ গ্রামের শিল্পীরাই তৈরি করত। অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে গাঁটছড়া বাঁধা ছিল। সমাজ গঠিত হত ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহকে নিয়ে। প্ৰতি জাতির একটা করে কৌলিক বৃত্তি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পৰ্যন্ত এই সকল কৌলিক বৃত্তি অনুসৃত হত। তারপর উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বাঙালী তার কৌলিক বৃত্তিসমূহ হারিয়ে ফেলে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর কৌলিক বৃত্তিধারী জাতিসমূহের বিবরণ আমরা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য থেকে পাই । মোটামুটি যে সকল জাতি বাঙলাদেশে বিদ্যমান ছিল, তা সমসাময়িককালে অনুলিখিত এক মঙ্গলকাব্যে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা এখানে উদ্ধৃত করছি–“সদগোপ কৈবর্ত আর গোয়ালা তাম্বুলি। উগ্ৰক্ষেত্ৰী কুম্ভকার একাদশ তিলি।। যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকার। নাপিত রাজক দুলে আর শঙ্খধর ।। হাড়ি মুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্ৰভৃতি। মাজি ও বাগদী মেটে নাহি ভেদজাতি ।। স্বর্ণকার সুবর্ণবণিক কৰ্মকার । সূত্ৰধর গন্ধবেনে ধীবর পোদ্দার ।। ক্ষত্ৰিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা । পড়িল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা ॥” এছাড়া, সকলের শীর্ষে ছিল ব্ৰাহ্মণ। এথেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল সমূহে ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্ৰাধান্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি প্রধান জেলায় কোন কোন জাতির কোন কোন জেলায় কিরূপ প্রাধান্য ছিল, তা পরপৃষ্ঠার ছকে দেখানো হচ্ছে–
স্থান মেদিনীপুর হুগলি বর্ধমান বাঁকুড়া বীরভূম ২৪ পরগণা নদীয়া
প্রথম ১ ১ ৫ ৯ ২ ১২ ১
দ্বিতীয় ২ ৫ ২ ৩ ৫ ১ ৬
তৃতীয় ৩ ৩ ৩ ৭ ৩ ৩ ৩
চতুর্থ ৪ ৬ ৬ ৬ ৮ ৫ ১১
পঞ্চম ৫ ২ ৭ ১১ ৯ ৬ ১০
জাতি–১-বৈবর্ত; ২-সদ্গোপ; ৩–ব্রাহ্মণ; ৪–তাঁতী; ৫-বাগদি; ৬-গোয়ালা; ৭-তিলি; ৮-ডোম; ৯-বাউরি; ১০-চণ্ডাল; ১১-চামার; ১২-পোদ।
লক্ষণীয় যে পশ্চিমবাঙলার এই সমস্ত জেলাসমূহে সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে কায়স্থদের প্রথম পাঁচের মধ্যে কোন জেলায় প্ৰাধান্য ছিল না । সমগ্ৰ পশ্চিমবাঙলার মোট জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্থান ছিল ছয় । প্ৰথম পাঁচ ছিল যথাক্রমে কৈবর্ত, বাগদি, ব্ৰাহ্মণ, সাদগোপ ও গোয়ালা। আজ কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম। তার কারণ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ‘জাত কাছারী’ স্থাপন করে জাতি নির্বিশেষে অনেক জাতির লোককেই ‘কায়স্থ’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে অনেক জাতের লোকই সামাজিক মৰ্যাদা লাভের জন্য নিজেদের ‘কায়স্থ’ বলে পরিচয় দিতে আরম্ভ করে ; এটা নাগরিক জীবনের পরিণাম মাত্র। কেননা, নগরবাসীরা আগন্তুকের কুলশীল সম্বন্ধে কেউই কিছু জানত না। সুতরাং আগন্তকের জাত যাচাই করবার কোন উপায় ছিল না । গ্রামের লোকেরা সকলেই সকলকে চিনত। সেজন্য সেখানে জাত ভাঁড়াবার কোন উপায় ছিল না । গ্রামের লোকেরা হয় নিজের গ্রামে, আর তা নয় তো নিকটের গ্রামেই বিবাহ করত। এই বৈবাহিকসূত্রে এক গ্রামের লোক নিকটস্থ অপর গ্রামের লোকেরও জাত জানত ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রামবাঙলায় এই সকল হিন্দুজাতি ছাড়া, ছিল আদিবাসীরা। মেদিনীপুরের আদিবাসীদের মধ্যে প্রধান আদিবাসী ছিল সাঁওতাল, লোধা ও হো। বাঁকুড়ার আদিবাসীদের মধ্যে ছিল কোরা, ভূমিজ, মাহালি, মেচ, মুণ্ডা, সাঁওতাল ও ওঁরাও। সকলের চেয়ে বেশি আদিবাসী ছিল বীরভূমে, প্ৰায় সবই সাঁওতাল। রাজশাহীর আদিবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলকবাহবে ছিল কম। এখানকার প্রধান আদিবাসী ছিল মুণ্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি। সাঁওতালদের ৭৩.৭৩ শতাংশ বাস করত মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বর্ধমাম, বাঁকুড়া, বীরভূম ও হুগলি জেলায়। বাকী অংশ বাস করত পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলায়। মুণ্ডারা অধিক সংখ্যায় (৬০.১৮ শতাংশ) বাস করত জলপাইগুড়ি ও চব্বিশ পরগণা জেলায়। বাকী ৩৯.৮২ শতাংশ বাস করত বাকী জেলাসমূহে। ওঁরাওদের ৮৯.০৪ শতাংশ বাস করত জলপাইগুড়ি, দাৰ্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর ও চব্বিশ পরগণায়। সমষ্টিগতভাবে পশ্চিমবাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে ৯০-১৫ শতাংশ ছিল সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, ভূমিজ, কোরা ও লোধা। তবে সাঁওতালরাই ছিল বাঙলার আদিম অধিবাসী । কিংবদন্তী অনুযায়ী তাদের জন্মস্থান ছিল মেদিনীপুরের সাঁওত পরগণায় ।