কলকাতায় ফিরে এসে ক্লাইভ এক সঙ্গীন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। কেননা, নবাব এক বিরাট বাহিনী নিয়ে আবার কলকাতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে সে সময় ইওরোপে ইংলণ্ড ও ফ্রান্স যুদ্ধে লিপ্ত থাকার দরুন ইংরেজরা সব সময়ই ভয় পেতে লাগল পাছে চন্দ্রনগর থেকে ফরাসী্রা কলকাতার ওপর কাপিয়ে পড়ে।
নবাবের বাহিনীতে ছিল ১৫,০০০ পদাতিক, ১০,৯০০ বিলদার, ৪০টি কামান, ৫০টি হাতি ও তার পিছনে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক বিরাট জনতা। ইংরেজদের তখন সম্বল হচ্ছে মাত্র ৭০০ ইওরোপীয় পদাতিক, ১৫ ০০ এদেশীয় সিপাই, ১৪টি কামান সহ ৮০০ গোলন্দাজ ও জাহাজের নাবিকেরা। কিন্তু সম্বল স্বল্প হলেও ক্লাইভ তার রণকৌশলে নবাবের বাহিনীকে শিয়ালদহের কাছে পরাহত করে। নবাব পালিয়ে গিয়ে আশ্ৰয় নেন দমদমের শিবিরে। নবাব সেখান থেকে শান্তি-স্থাপনের প্রত্যাশায় লিখে পাঠান যে তিনি কলকাতা ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ দেবেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হবেন। ইংরেজরা নবাবকে সদুত্তর দেওয়ায়, নবাব মুরশিদাবাদে ফিরে যান।
ছয়
এদিকে ইওরোপে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছিল, সেই সম্পর্কে ক্লাইভ চন্দ্রনগরের গভর্নরকে লিখে পাঠান যে বাঙলাদেশে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা একান্ত প্ৰয়োজন। কিন্তু পণ্ডিচেরীর গভর্নরের বিনা অনুমতিতে চন্দ্রনগরের গভর্নর ক্লাইভের প্রস্তাবে রাজা হলেন না। তখন ক্লাইভ ও ওয়াটসন সিরাজ কর্তৃক অনিচ্ছাসত্বে প্ৰদত্ত এক অনুমতিপত্রের বলে, চন্দ্রনগর আক্রমণ করেন। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ২৩ মার্চ তারিখে চন্দ্রনগর অধিকৃত হয়। কিন্তু ইংরেজরা শীঘ্রই দেখে যে সিরাজ ফরাসীদের সঙ্গে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, ইংরেজদের বাঙলাদেশ থেকে তাড়াবার জন্য। ইংরেজরা এতে ক্ষুব্ধ হয়। সিরাজের অমাত্যরা সিরাজের এই নীতিকে মুখতা বলে, মনে করে। এই সময় নবাবের সৈন্যাধ্যক্ষ মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে এক চক্রান্ত শুরু করে দেয়। এই চক্রান্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল নবাবকে গদিচ্যুত করে মীরজাফরকে নবাব করা। ক্লাইভ এতে সম্মত হয়। ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের জুন মাসে ক্লাইভ সসৈন্য মুরশিদাবাদের দিকে যাত্রা করে। ২৩ জুন তারিখে পলাশী নামে এক ক্ষুদ্র গ্রামের কাছে নবাববাহিনী ক্লাইভবাহিনীর মুখোমুখী হয়। নবাব পরাজিত হয়ে মুরশিদাবাদে পালিয়ে যান। রাত্রিকালে নবাব বেগম লুফৎ-অল-উন্নিসাকে নিয়ে গোপনে মুরশিদাবাদ ত্যাগ করেন। নিরাপত্তার আশায় উত্তরপ্রদেশের দিকে রওনা হন। কিন্তু পথিমধ্যে দানা শাহ নামে এক মুসলমান ফকির (যাকে সিরাজ একবার অপমান করেছিলেন) তাকে আশ্রয় দিয়ে গোপনে সে খবর মীরজাফরের কাছে পাঠিয়ে দেয়। মীরজাফরের লোকেরা এসে সিরাজকে ধরে নিয়ে যায়। মহম্মদী বেগ নামে এক ঘাতককে দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ হিসাবে নগণ্য হলেও, এরই ফলশ্রুতি হয়ে দাঁড়ায় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন। (পরিশিষ্ট দেখুন)।
ইংরেজের প্রভুত্ব
পলাশী যুদ্ধের পরই মীরজাফর ক্লাইভের সঙ্গে দাউদপুরে দেখা করে। ১৭৫৭ খ্ৰীস্টাব্দের ২৯ জুন তারিখে ক্লাইভ, মীরজাফরকে নবাবের মসনদে বসান। এই সময় থেকেই ইংরেজরা বাঙলার প্রকৃত অধিপতি হয়ে দাঁড়ায়, যদিও শাসনভার নবাবের হাতেই থাকে।
ইংরেজরা নবাবের কাছ থেকে অনেক কিছু সুযোগ-সুবিধা সংগ্ৰহ করে। তারা ২৪ পরগণার জমিদারী স্বত্ব পায়, বিনাশুল্কে ব্যবসা করবার অধিকার লাভ করে, এবং বাঙলার অভ্যন্তরস্থ অঞ্চলে কুঠি নির্মাণের অধিকার পায় কলকাতায়। তারা একটা টাকশালও স্থাপন করে, যেখানে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ১৯ আগস্ট তারিখ থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নিজ নামে মুদ্রা নির্মাণ হতে থাকে।
নবাব ইংরেজদের হাতে খেলার পুতুল হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় নবাব বুদ্ধিহীনের মত দুর্লভরাম, রামনারায়ণ সিং প্রভৃতির ন্যায় বিচক্ষণ হিন্দু কর্মচারীদের বরখাস্ত করে। এর ফলে রাজ্যের সর্বত্র অসন্তোষ ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। পাটনা, পূর্ণিয়া, মেদিনীপুর, ঢাকা প্ৰভৃতি স্থানে গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। নবাব ক্লাইভকে তা দমন করতে বলে। নবাবের এই উপকার সাধনের জন্য ইংরেজরা বিহারের সোরা বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার পায়।
১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম বাঙলা আক্রমণ করবার উদ্দেশ্যে বিহারের সীমান্তে এসে আবির্ভূত হন। নবাব তখন ইংরেজদের কাছ থেকে আবার সাহায্য প্রার্থনা করে। এর বিনিময়ে ইংরেজরা কলকাতার পার্শ্ববর্তী সমস্ত অঞ্চলের খাজনা আদায়ের অধিকার পায়।
ইংরেজদের এ রকম উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি দেখে ওলন্দাজরা ঈৰ্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা, সম্বন্ধে ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চালায়। এ সময় নবাবও ইংরেজদের ক্ৰমবধমান প্ৰভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে ওলন্দাজদের উৎসাহিত করে। নবাবের প্রকৃত মনোভাব যাই থাকুক না কেন, চুঁচুড়া ও চন্দ্রনগরের অন্তবর্তী বেদার নামক স্থানের যুদ্ধে, নবাব ইংরেজদেরই পক্ষ অবলম্বন করে। বেদারার যুদ্ধে ওলন্দাজরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়, এবং ইংরেজদের, ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, এই পরাজয়ের পরমুহুর্ভেই মীরজাফরের পুত্র মীরণ ওলন্দাজদের শান্তি দেবায় জন্য চুঁচুড়ায় এসে হাজির হয়। কিন্তু ইংরেজদের মধ্যস্থতায় ওলন্দাজরা মীরণের রোষের হাত থেকে রক্ষা পায়, তবে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা ভবিষ্যতে আর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হবে না, সৈন্যসামন্ত সংগ্ৰহ করবে না, এবং নিজ অঞ্চলে আর কোনরূপ দুৰ্গ নির্মাণ করবে না। বস্তুতঃ এর পর থেকেই বাঙলা দেশে ওলন্দাজদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে ওলন্দাজদের ঘাটি বরানগর ইংরেজদের হাতে চলে আসে। চুঁচুড়া আসে ১৮২৪ খীস্টাব্দে।