দুই
আলিবর্দি খান মারা যাবার পর থেকেই সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ঘটেছিল। বিরোধের কারণ আলিবর্দি খান জীবিত থাকা কালে ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে তাঁকে প্ৰবেশ করতে না দেওয়া, তার অভিষেককালে প্ৰথাঅনুযায়ী ইংরেজরা তাকে উপঢৌকন পাঠিয়ে অভিনন্দন না করা, রাজবল্লাভের বিরুদ্ধে অভিযোগকালে ইংরেজ কর্তৃক তাঁর পুত্ৰ কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান, বাণিজ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করা ও নবাবের আদেশের বিরুদ্ধে কলকাতার দুর্গ সুদৃঢ় করবার প্রয়াস।
কাশিমবাজার কুঠির অবরুদ্ধ ইংরেজরা মুক্তি পেয়ে, কলকাতায় এসে যখন -খবর দেয়, ইংরেজরা তখন একটু শঙ্কিত হয়ে পড়ে। বহুদিন শান্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকার দরুণ তারা উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া, বহুদিন সংস্কারের অভাবে দুৰ্গটাও অভেদ্য ছিল না। তারপর দুর্গটা ছিল বসতি এলাকার মধ্যে। আশেপাশে ইংরেজ ও এদেশীয় লোকদের অনেক ঘরবাড়ী ছিল। দুর্গপাড়ার মধ্যে বহুসংখ্যক পর্তুগীজও ছিল। সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণের তোড়জোড় করেন, তখন পর্তুগীজরা এসে আশ্ৰয় প্রার্থনা করল দুর্গের ভিতরে। দুৰ্গা-রক্ষণে তারা সহায়ক হবে ভেবে ইংরেজরা তাদের আশ্রয় দিল। কিন্তু পর্তুগীজরা তখন চারিত্রিক অবনতির চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছিল। সেজন্য তারা কোন কাজেই লাগিল না। বরং কাজের সময়ে দুৰ্গসংরক্ষণের পক্ষে একটা ঘোরতর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। এছাড়া ইংরেজরা দুৰ্গরক্ষার জন্য যে ১৫০০ বন্দুকধারী হিন্দু সৈনিক নিযুক্ত করেছিল, যুদ্ধের সময় তারাও পালিয়ে গেল।
তিন
সিরাজ কলকাতায় আসছে শুনে ইংরেজরা কলকাতাকে সুরক্ষিত করবার’ চেষ্টা করল। তিনটা তোপমঞ্চ বা ব্যাটারি স্থাপিত হল। তার মধ্যে একটা বাগবাজারে পেরিংস পয়েণ্টে। ১৭৫৬ খীস্টাব্দের ১৫ জুন তারিখে সিরাজ যখন কলকাতার সামনে এসে হাজির হলেন, তখন এখানেই নবাববাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের প্রথম সংঘর্ষ হল। ইংরেজরা নবাববাহিনীকে আটকাতে পারল না। নবাববাহিনী দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। নবাবের বাহিনীতে ছিল ৫০,০০০ পদাতিক ও বিস্তর গোলন্দাজ। তারা আসবার পথে দুধারের বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিল। সেগুলো লুণ্ঠন করল। বড়বাজার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করল। ভয়ে কলকাতার লোক শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল। নবাববাহিনী কর্তৃক ইংরেজরা তিন দিক থেকে আক্রান্ত হল। একমাত্ৰ ভাগীরথীর দিকটাই ইংরেজদের পক্ষে মুক্ত ছিল। মাত্র ৫০০ সৈনিক (তাদের মধ্যে শিক্ষিত সৈনিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭০) নিয়ে ইংরেজরা পাঁচ দিন ধরে দুর্গ রক্ষা করবার চেষ্টা করল। তারপর যখন দেখল দুর্গ রক্ষা করা সম্ভবপর হবে না, তখন নারী ও শিশুদের ভাগীরথীর বক্ষে অবস্থিত জাহাজসমূহে পাঠিয়ে দিল। দুর্গের সান্নিধ্যে তারা আরও জাহাজ রেখেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে দুর্গের পতন যখন একান্ত অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়াবে তখন তারা দুর্গের পিছনের দ্বার দিয়ে জাহাজে গিয়ে আশ্রয় নেবে। কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরস্থ ব্যক্তিগণ এমনই ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছিল যে তারা আগে থাকতেই জাহাজে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে ঘোষণা করে দিল। যে সব খতম। এই ঘোষণার পর ১৯ জুন তারিখের ভাঁটার স্রোতে জাহাজগুলো কলকাতা ত্যাগ করল। পলাতক ইংরেজরা ফালতায় গিয়ে আশ্রয় নিল। মাত্র কলকাতার জমিদার জন জেফানিয়া হলওয়েলের নেতৃত্বে কয়েকজন সাহসী লোক দুর্গের মধ্যে রয়ে গেল। পরদিন তারা শক্রর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেন না। দুর্গ নবাববাহিনীর করায়ত্ত হল।
এরপর নবাব কলকাতার নাম পরিবর্তন করে ‘আলিনগর’ রাখলেন, এবং শাসনভার মানিকচাঁদ নামে একজন হিন্দু শাসকের ওপর দিলেন।
চার
কলকাতা থেকে ফিরে এসে সিরাজ পূৰ্ণিয়ার শাসক শৌকত জঙ্গকে সায়েস্তা করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সিরাজ রাসবিহারী নামে এক ব্যক্তিকে পূর্ণিয়ার বীরনগরের ফৌজদার নিযুক্ত করে পাঠালেন, এবং শৌকত জঙ্গকে আদেশ দিলেন যে রাসবিহারীকে যেন তার পদে অধিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়। শৌকত সম্রাটের আদেশনামা (আগে দেখুন) প্ৰদৰ্শন করে বলল যে সম্রাট তাকেই বিহার, বাঙলা ও ওড়িশার শাসক নিযুক্ত করেছেন। সেই আদেশ অনুযায়ী সিরাজ যেন গদিত্যাগ করে অবসর গ্ৰহণ করে। সিরাজ এতে ক্রুদ্ধ হয়ে সেনাপতি মোহনলালের নেতৃত্বে এক বাহিনী নিয়ে রাজা কমলনারায়ণের সমভিব্যাহারে শৌকতকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে শৌকত নিহত হয়।
পাঁচ
এদিকে কলকাতার পতনের পর ইংরেজদের এক দ্রুতগামী জাহাজ এই বিপর্যয়ের খবর মাদ্রাজে নিয়ে যায়। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দের ১৬ অকটোবর তারিখে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে কলকাতার দিকে রওনা হয় পাঁচখানা যুদ্ধের জাহাজ (কেন্ট, কামবারল্যাণ্ড, টাইগার, স্যালিসবারী ও ব্রিজওয়াটার), একখানা কামানবাহী জাহাজ (ব্লেজ), তিনখানা বাণিজ্যতরী (প্রোটেকটর, ওয়ালপোল ও মারলবরে), ও তিনখানা দুই মাস্তুলওয়ালা ছোট জাহাজ (ল্যাপউইং, স্নো ও বনেটা)। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর জাহাজগুলো ফলতায় এসে উপস্থিত হয়।
ফলতা থেকে ইংরেজবাহিনী স্থলপথে ক্লাইভের ও জলপথে ওয়াটসনের নেতৃত্বে কলকাতার দিকে অগ্রসর হয়। বজবজে ক্লাইভ মুসলমানদের একটা দূর্গ অধিকার করে নেয়। ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে অগ্রসর হতে দেখে নবাবের লোকেরা কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের পয়লা -জানুয়ারী ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে আবার ব্রিটিশ পতাকা উডতীয়মান হয়। ১০ জানুয়ারী তারিখে ক্লাইভ হুগলী নগরী দখল করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। তারপর ইংরেজরা কলকাতায় ফিরে এসে শৃঙ্খলা স্থাপনের চেষ্টা করে।