সাধারণ লোকের মনে বঙ্গীর হাঙ্গামা এমন এক উৎকট ভীতি জাগিয়েছিল যে তা পরবর্তীকালে বাঙলার মেয়েদের মুখে ছেলেদের ঘুম পাড়ানো গানে প্রতিধ্বনিত হত।
বর্গীরা ভাগীরথী অতিক্রম করে মুরশিদাহ্বাদ শহর লুটপাট করে। জগৎশেঠের বাড়ী থেকে অনেক টাকা সংগ্রহ করে। ইংরেজদের কয়েকটা নৌকাও বৰ্গীরা লুটপাট করে। কলকাতার লোক ভয়ে সম্রান্ত হয়ে ওঠে। কাঠের রক্ষাবেষ্টনী থাকা সত্বেও ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে ইংরেজরা শহর সুরক্ষিত করবার জন্য দেশীয় বণিকদের সহায়তায় গঙ্গার দিক ছাড়া শহরের চারদিক ঘিরে ‘মারাঠা ডিচ’ খুঁড়তে আরম্ভ করে।
আলিবর্দি খান যখন ওড়িশা অভিযান থেকে ফিরছিলেন তখন বধৰ্মান শহরে রাণীন্দীঘির কাছে বৰ্গীরা তাঁর শিবির অবরোধ করে। নবাব অতি কষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। আলিবর্দি খান যখন মুরশিদাবাদে আসেন, বৰ্গীরা তখন কাটোয়ায় পালিয়ে যায়। পূজার সময় বৰ্গীর কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটায় দুর্গাপূজা করে। কিন্তু ওই পূজা অসমাপ্ত থাকে, কেননা নবমীর দিন আলিবর্দি খান অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের তাড়িয়ে দেন। তারপর বালেশ্বরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারাঠারা চিলক হ্রদের দক্ষিণে পালিয়ে যায়।
পরের বছর (১৭৪৩) রঘুজী ভোঁসলে নিজে বাঙলা দেশ আক্রমণ করেন। দিল্পীর বাদশাহ মহম্মদ শাহের অনুরোধে পেশওয়া বালাজী বাজীরাও বাঙলাদেশ থেকে বৰ্গীদের তাড়িয়ে দিতে সম্মত হন। আলিবর্দি খান স্বীকার করেন যে তিনি মারাঠারাজা শাহুকে বাঙলাদেশের চৌথ এবং পেশওয়াকে যুদ্ধের খরচ বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দিবেন। পেশওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রঘুজী ভোঁসলে পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাতে কোন স্থায়ী ফল হল না। বগীরা প্ৰতি বছরই বাঙলা দেশে এসে উৎপাত করতে লাগল। ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে আলিবর্দি খান ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সেনাপতিদের সন্ধির অছিলায় মুরশিদাবাদের কাছে মানকর নামক স্থানে নিজ শিবিরে আমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর বগীরা বছর খানেক হাঙ্গামা বন্ধ রাখে। কিন্তু তারপর হাঙ্গামা আবার শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত আলিবর্দি খান বর্গীদের সঙ্গে আর পেরে ওঠেন নি, এবং সন্ধি করতে বাধ্য হন। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দের সন্ধি অনুযায়ী আলিবর্দি খান ওড়িশা বৰ্গীদের হাতে তুলে দেন। মারাঠারা প্ৰতিশ্রুতি দেয় যে তারা ওড়িশা থেকে সুবর্ণরেখা নদী অতিক্রম করে বাঙলাদেশে আর ঢুকবে না। জলেশ্বরের কাছে সুবর্ণরেখার পূর্বতীর পর্যন্ত আলিবর্দি খানের রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়। আলিবর্দি খান প্ৰতি বৎসর বাঙলাদেশের চৌথ হিসাবে ১২ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দেন।
বৰ্গীর হাঙ্গামা নিয়ে বাঙলাদেশে অনেক কিংবদন্তীর সৃষ্টি হয়েছিল। বীরভূমের বৈষ্ণবগণের মধ্যে এক কিংবদন্তী আছে যে এক যোগিনীসিদ্ধ ব্ৰাহ্মণ আনন্দচন্দ্ৰ গোস্বামী (যাকে বৈষ্ণবগণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবতার ভাবেন) অলৌকিক শক্তিবলে বর্গীর হাঙ্গামা দমন করেছিলেন। আনাসহিদ নামে একজন পীর সাহেবও-বৰ্গীদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মারা যান। বীরভূমের রামপুরহাটের নিকট নলহাটিতে এক পাহাড়ের ওপর তার স্মৃতি-সমাধি বর্তমান।
মুরশিদকুলি খানের ন্যায় আলিবর্দি খান যোগ্য শাসক হলেও, দেশ ক্রমশ অবক্ষয়ের পথেই এগিয়ে গিয়েছিল। বর্গীর হাঙ্গামার ফলে দেশের এক বিশাল অঞ্চল বিধবন্ত হয়েছিল। বহুস্থানে কৃষিভূমি ও লোকালয় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। বিবেচক শাসক হলেও আলিবর্দি খান বর্গীদের বাধা দেবার প্রয়োজনে দুৰ্ভিক্ষক্লিষ্ট প্রজাদের করভারে জর্জরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৭৫৬ খ্ৰীস্টাব্দে আলিবর্দি খান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ জামাত (আলিবর্দি খানের কনিষ্ঠ কন্যা আমিন বেগমের সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র জিনুউদ্দিনের বিবাহ হয়েছিল) জিনুউদ্দিনের পুত্র মিরজা মহম্মদ (ওরফে সিরাজদ্দৌলা)-কে নবাব পদে মনোনীত করে যান।
সিরাজদ্দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ
সুদৰ্শন এই যুবক তার উচ্ছঙ্খল জীবন ও অসচ্চরিত্রের জন্য প্ৰসিদ্ধ ছিলেন। কথিত আছে যে একবার তিনি গঙ্গাবক্ষে নৌকাবিহারের সময় নৌকা থেকে নাটোরের রাণী ভবানীর বাল্যবিধবা কন্যা তারাসুন্দরীকে ছাদের ওপর চুল শুকাবার সময় দেখে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার হারেমে তাঁর কন্যাকে পাঠাবার জন্য রাণী ভবানীকে আদেশ দেন। রাণী ভবানী রাতারাতি কন্যাকে এক সাধুত্ব আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের মানসন্ত্রম রক্ষা করেন। আলিবর্দি খান জীবিত থাকাকালীনই সিরাজের নিষ্ঠুর ও উচ্ছঙ্খল আচরণে তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা উত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। ঢাকার শাসক তাঁর জ্যেষ্ঠ মেসো নুয়াজিশ মহম্মদের শক্তি খর্ব করবার জন্য সিরাজ হুসেনউদ্দিন ও হুসেনকুলি খান নামক নুয়াজিশের দুই প্ৰতিভূকে হত্যা করে। ১৭৫৬ খ্ৰীস্টাব্দে মুরশিদাবাদে নুয়াজিশের মৃত্যু ঘটে এবং সেই বৎসর আলিবর্দি খানও মারা যান। বাঙলার মসনদে আরোহণ করেই সিরাজ নুয়াজিশের সমস্ত সম্পত্তি অপহরণ করে ও তার বিধবা ঘাসিতি বেগমকে (সিরাজের মাসী) তার মতিঝিলের প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়। ঢাকার উপশাসক রাজবল্লভের কাছ থেকে তিনি অনেক টাকা চেয়ে পাঠান। রাজবল্লভ ভীত হয়ে তাঁর পুত্র কৃষ্ণবল্লভ ও তার পরিবারবর্গকে তার সমস্ত ধনরত্নাদি সমেত কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন। সিরাজ তাঁর দুই সাখী মোহনলাল ও মীরমাদনকে যথাক্রমে দেওয়ান ও সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন। মীরজাফর খান (আলিবর্দি খানের বৈমাত্রেয় ভগিনী শাহ খানের স্বামী }-কেও তিনি তার পদ থেকে অপসৃত করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু মীরজাফর পূর্ণিয়ার শাসক শোকত জঙ্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে দিল্লীতে গিয়ে সম্রাটের দরবারে প্রভাব সঞ্চয় করে একখানা আদেশনামা সংগ্ৰহ করে, যার দ্বারা শোকত জঙ্গকে বাঙলার শাসক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সিরাজ আগে থাকতে সংবাদ পেয়ে শৌকত জঙ্গের এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হয়। কিন্তু পূর্ণিয়া পৰ্যন্ত তার যাওয়া হয় না, কেননা, রাজমহলে পেঁৗছে সিরাজ খবর পান যে ইংরেজরা কলকাতা দুর্গে শক্তি সঞ্চয় করছে ও দুর্গ সুদৃঢ় করছে। সিরাজ কাশিমবাজারে ফিরে এসেই ইংরেজদের কাশিমবাজারের কুঠি লুণ্ঠন ও অধিকার করেন। এছাড়া, তিনি কাশিমবাজারে অবস্থিত ইংরেজ বণিকদের বন্দী করেন। এই বন্দীদের মধ্যে তরুণ বয়স্ক ওয়ারেন হেষ্টিংসও ছিলেন। তখন তিনি কাশিমবাজারের কুঠিতে করণিকের কাজ করতেন। কিন্তু কাশিমবাজারে অবস্থিত ফরাসী ও ওলন্দাজদের মধ্যস্থতায়, এবং তারা ইংরেজদের হয়ে জামিন দেওয়ায় সিরাজ বন্দী ইংরেজ-বণিকদের মুক্তি দেয়। তখন তারা কলকাতায় এসে কর্তৃপক্ষকে সমস্ত খবর দেয়।