পাঁচ
এই ঘটনার এক বৎসর পূর্বে ফারুকশিয়ার যখন পাটনাতে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কিছু প্ররোচনার বশীভূত হয়ে রশিদ খান নামক এক ব্যক্তিকে বাঙলার শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র মুরশিদকুলি খান রশিদ খানকে মুরশিদাবাদের নিকট ‘প্ৰতিরোধ করেন। রশিদ খানের সঙ্গে মুরশিদকুলি খানের যে সংঘর্ষ হয়, সেই সংঘর্ষে রশিদ খান নিজ অশ্ব থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। কিন্তু ফারুকশিয়ার যখন হিন্দুস্থানের সম্রাট হন (১৭১৩) মুরশিদকুলি খান তখন নিজ কুটবুদ্ধি অনুযায়ী সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তাকে বহু মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। ফারুকশিয়ারও মুরশিদকুলি খানকে বাঙলা ও ওড়িশার স্ববেদার নিযুক্ত করেন। তখন মুরশিদকুলি খান মুকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে মুরশিদাবাদ রাখেন (১৭১৩ খ্রীস্টাব্দ)।।
এইভাবে শক্তিমান হবার পর মুরশিদকুলি খান ইংরেজদের সঙ্গে কলহে প্ৰবৃত্ত হন। শাহজাদা শুজার কাছ থেকে ইংরেজরা যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল, সেগুলি তিনি বাতিল করে দেন। বাৰ্ষিক তিন হাজার টাকা প্ৰদানের পরিবর্তে ইংরেজরা অবাধ বাণিজ্যের যে অধিকার পেয়েছিল, তাও নাকচ করে তিনি আদেশ দেন যে হিন্দুরা যে বাণিজ্য শুষ্ক দেয়, ইংরেজদেরও তা পুরামাত্রায় দিতে হবে। নবাবের এরূপ আচরণে বিক্রত হয়ে ইংরেজরা দিল্লীতে সম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করে। ১৭১৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি জন সুরম্যান ও এডওয়ার্ড ষ্টিভেনসন নামে দুই ব্যক্তিকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করে সরাসরি দিল্লীতে বাদশাহ ফারুকশিয়ারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে যায় দোভাষী হিসাবে খোজা সারহাউদ ও চিকিৎসক হিসাবে ক্যাপটেন উইলিয়াম হামিলটন। তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায় বহুমূল্য উপঢৌকন। মুরশিদকুলি খান দূতদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবার চেষ্টা করেন, কিন্তু এক আকস্মিক ঘটনা ইংরেজদের সহায়ক হয় এবং তারা সম্রাটের কাছ থেকে সহানুভূতিশীল ব্যবহার পায়। ঘটনাটা আর কিছুই নয়, সম্রাটের অণ্ডকোষের এক কঠিন পীড়া। ১৭২৩ খ্রীস্টাব্দে বাদশাহ ফারুকশিয়ারের আদেশে হুসেন আলি খান নামক সেনাপতির অধীনে মোগল বাহিনী যোধপুর আক্রমণ করে। যোধপুরের রাজা অজিত সিং পরাহত হয় এবং সন্ধির শর্ত অনুযায়ী অজিত সিং তার মেয়ের সঙ্গে বাদশাহের বিবাহ দিতে রাজী হয়। কিন্তু সম্রাট হঠাত পীড়িত হওয়ায়, এই বিবাহে বিঘ্ন ঘটে। এই মুহূর্তেই ইংরেজ কোম্পানির দূতগণ দিল্লীতে গিয়ে হাজির হয়। ইংরেজ দূতগণের সঙ্গে আগত চিকিৎসক ডাক্তার উইলিয়াম হামিলটন সম্রাটকে পীড়ামুক্ত করে। এভাবে তার বিবাহের পথ প্ৰশন্ত হয়। সম্রাট খুশী হয়ে ইংরেজদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন ও তাদের ফরমান দেন। ইংরেজদের প্রার্থনা ছিল-(১) কলকাতার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছাড়পত্র প্ৰদৰ্শন করলে, নবাবের কোন কর্মচারী নৌপথে আগত ইংরেজদের কোন মাল আটক বা পরীক্ষা করতে পারবে না, (২) সপ্তাহে তিনদিন মুরশিদাবাদের টাকশালে ইংরেজদের মুদ্রা নির্মাণের অধিকার থাকবে, (৩) ইংরেজরা অনুরোধ করা মাত্র ইংরেজদের কাছে ঋণী এরকম ব্যক্তিকে ইংরেজদের হাতে সমৰ্পণ করতে হবে, এবং (s) কলকাতার সংলগ্ন ৩৮ খানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব তারা কিনতে পারবে। ফারমান দ্বারা সম্রাট ইংরেজদের এ সকল প্রার্থনা মজুর করেন। মুরশিদকুলি খান সম্রাটের আদেশ অমান্য করতে সাহস করলেন না। কিন্তু ৩৮ খানা গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কেনা সম্বন্ধে তিনি স্থানীয় জমিদারদের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করলেন যে সে সম্পর্কে ইংরেজদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।
১৭১৮ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়ার মুরশিদকুলি খানকে বিহারেরও শাসক নিযুক্ত করেন। ১৭১৯ খ্রীস্টাব্দে ফারুকশিয়ারের মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর সাত মাসের মধ্যে পার পর দুজন সম্রাট হন; তারপর ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ দিল্লীর বাদশাহ হন। তিনিও মুরশিদকুলি খানকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার শাসক পদে বহাল রাখেন। কিন্তু মুরশিদকুলি খান দিল্লীর সঙ্গে নামমাত্র সম্পর্ক রেখে নিজেই স্বাধীন শাসক হয়ে ওঠেন। এভাবে তিনি বাঙলায় নবাবী আমলের স্বচনা করেন। ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে মুরশিদকুলি খানের মৃত্যু ঘটে।
মুরশিদকুলি খান যোগ্য শাসক হলেও, দেশের আর্থিক বা সামাজিক অবস্থার কোন উন্নতি ঘটাতে পারেন নি। তাঁর হিন্দুবিদ্বেষ এবং জমিদার ও প্রজাদের পীড়ন করে অর্থসংগ্ৰহ করার ফলে দেশে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক শোষণে বাঙলা ক্রমশ জীৰ্ণ হতে আরম্ভ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের সময় দেশের লোকের দুর্দশার সীমা থাকত না। পরবর্তী শাসকদের সময় এই অবস্থাই চলেছিল। মোটকথা, গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীতেই বাঙালী সমাজে দৈন্যতা করেছে। মুখব্যাদান। বৎসরের পর বৎসর দিল্লীতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব প্রেরণের ফলে বাঙলায় রৌপ্য মুদ্রার অভাব ঘটেছিল, যার পরিণতিতে কেনাবেচা ও লেনদেন প্ৰাচীন প্ৰথানুযায়ী কড়ির মাধ্যমেই হওয়া ব্যাপকভাবে প্ৰচলিত হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের সময় পৰ্যন্ত এই অবস্থা বহাল থাকে।
আলিবর্দি খান ও বর্গীর হাঙ্গামা
তাঁর মৃত্যুর পূর্বে মুরশিদকুলি খান তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খানকে বাঙলার নবাব মনোনীত করে যান। কিন্তু সরফরাজ খানের পিতা শুজাউদ্দিন নিজেই পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাড়ান। আমলার চক্রান্ত করে পিতা শুজাউদ্দিনকেই বাঙলার নবাব করে। তবে তিনি নবাব হবার পর পুত্র সরফরাজ খানকে দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করেন। নবাবের গদিতে উপবিষ্ট হয়েই শুজাউদ্দিন মুরশিদকুলি খান কর্তৃক কারারুদ্ধ বাঙলার জমিদারদের মুক্তি দেন। নিজ বন্ধু-বান্ধব অনেককে তিনি রাজকাৰ্যে নিযুক্ত করেন। দেশশাসন বিষয়ে তিনি নিকট আত্মীয় হাজি আহম্মদ ও আলিবর্দি খান ও রায়রায়ন আলমৰ্চাদ ও জগৎশেঠ ফতেচাদ প্ৰমুখদের উপদেশ অনুসরণ করেন। সম্রাটের সঙ্গে তিনি অটল আনুগত্যসম্পন্ন সম্পর্ক রাখেন। দিল্লীতে নিয়মিতভাবে রাজস্ব প্রেরণ ছাড়া, বহু অর্থ ও উপঢৌকন সম্রাটকে (মহম্মদ শাহকে) পাঠাতেন। তিনি নিজ সৈন্যবল বৃদ্ধি করেছিলেন এবং পুনরায় বিহার অধিকার করে সেখানে তাঁর প্ৰতিভূ হিসাবে আলিবর্দি খানকে নিযুক্ত করেন।