নাদির শাহ মুঘল সাম্রাজ্যকে একেবারে নিঃস্ব ও ভূশায়িত করে দিয়ে যায়। সংহত কেন্দ্রীয় শক্তি বলে আর কিছুই থাকে না। দাক্ষিণাত্যে বিশৃঙ্খলতা প্ৰকাশ পায়। পশ্চিম ভারতে মারাঠারা আরও প্ৰবল হয়ে ওঠে। উত্তর ভারতে শিখরাও আরও শক্তিশালী হয়। ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে মারাঠা বৰ্গীরা — বাঙলায় গিয়েও হামলা শুরু করতে সাহস পায়।
মুরশিদকুলি খানের শাসন
অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনায় বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসের প্রধান নায়ক ছিলেন, মুরশিদকুলি খান। ১৭০০ খ্ৰীস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে বাঙলার দেওয়াননিযুক্ত করেন। ঢাকা তখন বাঙলা স্কবার রাজধানী। সুবেদার। আজিম-উসশানের সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হওয়ায়, মুরশিদকুলি খান তাঁর দপ্তর ঢাকা থেকে – মুকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। মুরশিদকুলি খান বাঙলার রাজস্ব বিভাগের গলদগুলি লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন যে বাঙলা স্ববার বেশীর ভাগ অংশই সামরিক জায়গীরদারদের হন্তে ন্যস্ত। যে অংশ সরাসরি সুবেদারের নিয়ন্ত্রণে, তার আয় স্ববার সামরিক ও অসামরিক শাসন বিভাগের ব্যয় নির্বাহের পক্ষে ষথেষ্ট নয়। এই কারণে বাঙলা সুবা সবসময়েই ঋণে ডুবে থাকত, এবং এই ঋণ। পরিশোধ করা হত। অন্যান্য সুবার অর্থে। মুরশিদকুলি খান দেখলেন যে বাঙলার রাজস্ব প্ৰভূত পরিমাণে বাড়ানো যেতে পারে, যদি সমস্ত ভূম্যধিকারীদের সরাসরি দেওয়ানের অধীনস্থ করা হয়। তিনি এই প্ৰস্তাব ঔরঙ্গজেবের নিকট পেশ করেন। সম্রাট তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করেন।
রাজস্ব আদায় ও জমি বিলির স্থব্যবস্থা করে, মুরশিদকুলি খান বাঙলা দেশের মালগুজারী বাবদ প্ৰতি বৎসর এক কোটি টাকা ঔরঙ্গজেবকে পাঠাতে থাকেন। তার মানে সম্রাটকে খুশী করে নিজের পদ সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বাঙলাকে তিনি দোহন করতে শুরু করেছিলেন। বাঙলার রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এতে বাঙলার সুবেদার। আজিম-উস-শান ভঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। তিনি মুরশিদকুলি খানকে হত্যার জন্য, আবদুল ওয়াহিদ নামক নগদি অশ্বারোহী বাহিনীর এক সেনাপতির সঙ্গে এক চক্রান্ত করেন। পথিমধ্যে তাকে হত্যার জন্য তিনি মুরশিদকুলি খানকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। পথে মুরশিদকুলি খান আক্রান্ত হন। কিন্তু আক্রমণের মুর্শিদকুলি খান অসাধারণ সাহস প্ৰদৰ্শন করায়, এই চক্ৰান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। ঢাকায় পৌঁছে মুরশিদকুলি খান আজিম-উল শানকে এই চক্রান্তের স্রষ্টা হিসাবে দোষী করেন ও ছোরা হাতে নিয়ে বলেন- ‘তুমি যদি আমার প্রাণ নিতে চাও, তাহলে এখানেই তার মীমাংসা হয়ে যাক, নচেৎ তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে এরূপ কাৰ্য থেকে তুমি ভবিষ্যতে বিরত থাকবে।‘ আজিম-উস-শান এ বিষয়ে নিজেকে নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং আবদুল ওয়াহিদকে ভৎসনা করে তার সৈন্যদলকে রাজকীয় বাহিনী থেকে অপস্থত করেন। তারপর মুরশিদকুলি। খান এই ঘটনার এক যথার্থ প্ৰতিবেদন ঔরঙ্গজেবের কাছে পাঠিয়ে দেন। মুরশিদকুলি খানকে হত্যার চক্রান্তের প্রতিবেদন পেয়ে ঔরঙ্গজেব ক্রোধান্বিত হয়ে আজিম-উস-শানকে লিখে পাঠান যে মুরশিদকুলি খানের কোন ক্ষতি হল আজিম-উল-শান তার পৌত্র বলে রেহাই পাবে না, তিনি যথাযথ শান্তি দিবেন। এ ছাড়া তিনি আজিম-উস-শানকে বাঙলা ত্যাগ করে বিহারে এসে বাস করতে আদেশ দেন। এই আদেশের পর আজিম-উস-শন বাঙলার শাসনভার তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ফারুকশিয়ারের ওপর অর্পণ করে, পাটনায় চলে যান।
দুই
নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মুরশিদকুলি খান রাজস্বের পরিমাণ রীতিমত বাড়িয়ে তোলেন, এবং সশরীরে সম্রাটের নিকট হিসাব-নিকাশ দিতে যান। সম্রাট তার কার্যের প্রশংসা করেন। এছাড়া, তিনি তাঁকে সম্মানিতও করেন। মুরশিদকুলি খানকে তিনি বিহার, বাঙলা ও ওড়িশা এই তিন প্রদেশের দেওয়ানের পদে – পুনর্নিযুক্ত করেন। উপরন্তু তাঁকে বাঙলা এবং ওড়িশার ডেপুটি নিজাম পদেও উন্নীত করেন। আজিম-উশ-শান এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন, কিন্তু তাঁর পিতামহের। স্বৈরতান্ত্রিক মেজাজের কথা স্মরণ করে, কিছু করতে সাহস করেন না। ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেবের সন্তানদের মধ্যে হিন্দুস্থানের মসনদ নিয়ে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়, এবং তঁরে তৃতীয় পুত্ৰ সুলতান মহম্মদ আজিম সম্রাটের প্রিয়পাত্র হয়। মহম্মদ আজিম তার ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ আজিম-উশ-শানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে পাটনা থেকে দিল্লীতে প্ৰত্যাগমন করতে বলে। এই ঘটনারই কিছু পরে ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু ঘটে। জাজোঁ নামক স্থানে মহম্মদ আজিমও নিহত হয়।
আজিম-উশ-শান পাটনা থেকে দিল্লীতে আহুত হবার পর মুরশিদকুলি খানই কার্যত বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার শাসক হয়ে দাঁড়ান, যদিও আজিম-উল্-শান তাঁর পুত্র ফারুকশিয়ারকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে নাজিমের গদিতে বসিয়ে গিয়েছিলেন।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বাহাদুর শাহ (আজিম-উস্-শানের পিতা) যখন দিল্লীর সম্রাট হন, তখন তিনি পুত্ৰ আজিম-উস-শানের প্ররোচন, মুরশিদকুলি খানকে দক্ষিণাত্যের দেওয়ান করে পাঠান। কিন্তু বাঙলার নূতন শাসক বিদ্রোহী সেনার হাতে নিহত হওয়ায় সম্রাট দেওয়ান ও ডেপুটি নিজামের পদদ্বয় একত্রিত করে মুরশিদকুলি খানকেই বাঙলার শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দেন। মুরশিদকুলি খান মেদিনীপুর জেলাকে ওড়িশা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঙলার সঙ্গে { যুক্ত করেন, এবং নিজ জামাতা শুজাউদ্দিন মহম্মদ খানকে ওড়িশার ডেপুটি নিজাম পদে অধিষ্ঠিত করেন। দুই হিন্দু ব্রাহ্মণকে তিনি দুই বিশ্বস্ত পদ দেন। তাদের মধ্যে ভূপত রায়কে তিনি ট্রেজারী বা খালসার সচিব ও কিশোর রায়কে তার গোপন সচিব বা প্ৰাইভেট সেক্রেটারী নিযুক্ত করেন। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের প্রতি তার ব্যবহার অত্যন্ত অত্যাচারপূর্ণ ছিল। প্রদেশের রাজস্ব সম্বন্ধে প্ৰকৃত পরিস্থিতি জানবার জন্য তিনি তাদের বন্দী করেন ও নিজ প্ৰতিনিধির দ্বারা রাজস্ব আদায় করেন। বাঙলার মাত্র দুজন জমিদার এরূপ ব্যবহার থেকে অব্যাহতি পায়। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে বীরভূমের আফঘান ভূস্বামী আশা-উদ-দৌল, -ব্যায়পরায়ণ বাক্তি হিসাবে যার সুনাম ছিল এবং যিনি তার আদায়ীকৃত খাজনার অর্ধেক অংশ জনহিতকর কাজে ব্যয় করতেন। আর অপরজন হচ্ছেন বিষ্ণুপুরের জমিদার, যার জমিদারীর অধিকাংশই অনুর্বর ছিল এবং যিনি ঝাড়খণ্ডের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আক্রমণ প্রতিহত করে সরকারকে সাহায্য করতেন। এদের দুজনকে তিনি তাদের জমিদারীতে বহাল রেখেছিলেন এই শর্তে যে তারা নিয়মিতভাবে মুরশিদাবাদের খাজাঞ্চীখানায় রাজস্ব জমা দিবে। এ ছাড়া, মুরশিদকুলি খান বাঙলার সমস্ত জমির নূতন করে জরীপ করেছিলেন (১৭২২)। এই জরীপ ‘জমা-ই-কামিল তুমার’ নামে পরিচিত। এই জরীপ অনুযায়ী বাঙলা দেশকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করা হয়। এই ১৩টি চাকলার অন্তভুক্ত মহাল বা পরগণার সংখ্যা ছিল ১৬৬০ ও রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১,৪২,৮৮,১৮৬ টাকা।