কথামুখ (আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী)
উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা ও বাঙালী সম্বন্ধে অগণিত বই ও প্ৰবন্ধ লেখা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার পূর্বগামী শতাব্দী, আঠারো শতক সম্বন্ধে আমরা এক শূন্যময় পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। ইতিহাসের আসরে উনবিংশ শতাব্দীকে বিশেষ মৰ্যাদা দেবার পিছনে অবশ্য একটা যুক্তি আছে। উনবিংশ শতাব্দী ছিল একটা ঘটনাবহুল শতাব্দী, যে সকল ঘটনার ফল-সমষ্টিতে স্বই হয়েছিল বাঙলায় নবজাগরণ । তার মানে উনবিংশ শতাব্দী ছিল একটা রূপান্তরের যুগ । সেদিক থেকে আঠারো শতকও কম ঘটনাবহুল ছিল না। তা ছাড়া, আঠারো শতক অবক্ষয়ের যুগ হলেও নবজাগরণোত্ন প্ৰস্তুতিপৰ্ব আঠারো শতকের শেষের দিকেই ঘটেছিল । বস্তুতঃ বাঙলার ইতিহাসে আঠারো শতক চিহ্নিত হয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণের যুগ হিসাবে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই শতাব্দীতে আমরা এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করি। রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে এই শতাব্দীর গোড়াতেই ঘটেছিল দিল্লীতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মুঘলশক্তির অবনতি । এই অবনতির অন্তরালেই বাঙলায় নবাবী আমলের সুচনা হয়েছিল, যার পদস্থলনে ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে। এই পলাশীর যুদ্ধই বাঙলায় বপন করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বীজ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণভাবে বিপর্যন্ত করেছিল বাঙলার জনজীবনকে। বৰ্গীর হাঙ্গামার দুঃস্বপ্ন ছাড়া, পলাশীর যুদ্ধের সময় পৰ্যন্ত বাঙলার জনজীবন মুখরিত ছিল সুখ, শাস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রাচুর্যে। এর বহিঃপ্রকাশে বাঙলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ধারা অব্যাহত ছিল। প্ৰধান প্ৰধান ভূম্যাধিকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবিজন রচনা করে যাচ্ছিলেন নানাবিধ মঙ্গলকাব্যসমূহ। আবার তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলায় নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য দেবদেউল । দুর্ভিক্ষ মাঝে মাঝে আবির্ভূত হত বটে (এখনও আবির্ভূত হয়), কিন্তু সুফলার বছরে বাঙালী অতীতের ক্লেশ ভুলে যেত। আবার দৈনন্দিন জীবন আনন্দময় হয়ে উঠত। আনন্দের স্রোতে অবগাহন করে বাঙালী বার মাসে তের পার্বণ করত। সারা বৎসর নিজেকে মাতিয়ে রাখত। এই আনন্দময় জীবন পযুদন্ত হয়, যখন ১৭৬৫। খ্রীস্টাব্দে দুর্বল রাজশক্তির অনুগ্রহে ইংরেজ দেওয়ানী লাভ করে। দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজ জনজীবনের সঙ্গতির ওপর প্রথম হস্তক্ষেপ করে। এর আগে বাঙলার ঘরে ঘরে সুতা কাটা হত, এবং সেই সুতার সাহায্যে বাঙালী তাঁতীরা বস্ত্ৰ বয়ন করে তা বিদেশীদের বেচে প্ৰভূত অর্থ উপার্জন করত। দেওয়ানী পাবার মাত্র চার বছর পরে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৭ই মার্চ তারিখে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত ডিরেকটাররা এখানকার কর্মচারীদের লিখে পাঠাল–“বাঙলার রেশম বয়নশিল্পকে নিরুৎসাহ করে মাত্র রেশম তৈরির ব্যবসায়কে উৎসাহিত করা হউক ৷” শীঘ্রই অনুরূপ নীতি কার্পাসজাত বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা হল । ইংরেজ এখান থেকে কাঁচা মাল কিনে বিলাতে পাঠাতে লাগল, আর সেই কাঁচামাল থেকে প্ৰস্তুত দ্রব্য বাঙলায় এনে বেচিতে লাগিল । বাঙলা ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ল। বাঙলার শিল্পসমূহ জাহান্নামে গেল। বাঙালী কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ল। ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দ থেকে সাহেবরা নীলচাষের প্রবর্তন করল । নীলচাষ দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচারের একটা যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। তন্তুবায়দের ভাত মারা যাবার ফলে, তন্তবায়দের বিদ্রোহ ছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদ আরও চিহ্নিত হয়ে আছে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও চুয়াড় বিদ্রোহ দ্বারা। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’-এর পদচিহ্নে। আর চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটেছিল বাঙলার আদিবাসীদের জীবিকার সূত্র ইংরেজগণ কর্তৃক রুদ্ধ হওয়ার ফলে। শুধুমাত্র বাঙলার অর্থনৈতিক জীবনই ষে এভাবে পর্যুদন্ত হয়েছিল, তা নয়। যুগ যুগ ধরে অনুসৃত বাঙলার ধর্মীয় জীবনের ওপরও ইংরেজ হাত দিয়েছিল। ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা বাঙলায় অনুষ্ঠিত করেছিল প্ৰথম ব্ৰহ্মহত্যা । নিছক চক্রান্ত করে ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে তারা ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছিল নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণসন্তান মহারাজা নন্দকুমারকে। এ সব দুৰ্যোগ ও দুৰ্গতির পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটেছিল বাংলা হরফের সৃজন, যা উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের সাথক রূপায়ণে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।
।। দুই ।।
আজ পর্যন্ত আঠারো শতক সম্বন্ধে যা কিছু বই লেখা হয়েছে, তা কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে কতকগুলো ভূঁইফোঁড় বড়লোক ও ইংরেজের বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস। আঠারো শতকের বাঙলার গ্রামীণ সমাজজীবন সম্বন্ধে কিছুই লেখা হয়নি। সমগ্র বাঙলা দেশকে নিয়েই গঠিত ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পুর্বদিকের প্রত্যন্ত সুবা । তারাই এর নাম দিয়েছিল ‘সুবে বাঙলা” । মুঘলরা বাঙলা সুবা তৈরি করেছিল, পাঠান শক্তির পতনের পর সম্রাট আকবরের আমলে মানসিংহ যখন বাঙলা জয় করে। মানসিংহের সমসাময়িক মুঘল রাজস্ব সচিব তোদরমল্লের ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ থেকে আমরা জানতে পারি যে সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বাঙলা দেশ ৬৮৯ মহাল-বিশিষ্ট ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল । তখন বাঙলা থেকে রাজস্ব আদায় হত ৩,২৬,২৫০ টাকা । কিন্তু কালক্রমে হিজলি, মেদিনীপুর, জলেশ্বর, কুচবিহারের কিছু অংশ, পশ্চিম আসাম ও ত্রিপুরা বাঙলার সহিত সংযুক্ত হওয়ার ফলে, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় বাঙলা ১৩৫০ মহাল বা পরগণা বিশিষ্ট ৩৪টি সরকারে বিভক্ত হয় এবং রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা । এই রাষ্ট্ৰীয় বিন্যাসই অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় বলবৎ ছিল। কিন্তু মুরশিদকুলি খান যখন নবাবী আমলের উদ্বোধন করল, তখন এর পরিবর্তন ঘটল । ১৭২২ খ্ৰীস্টাব্দে প্ৰণীত ‘জমা-ই- কামিল-তুমার’ অনুযায়ী বাঙলা দেশকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করা হল। তখন মহাল বা পরগণার সংখ্যা ছিল ১৬৬০ ও রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১,৪২,৮৮,১৮৬ টাকা । ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইংবেজরা যখন দেওয়ানী লাভ করে তখন রাজস্বের স্ফীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২,৫৬,২৪,২৩৩ টাকায়।