বহুপতি গ্রহণের দুষ্টান্ত মহাভারতে মাত্র একটিই আছে। পাণ্ডবভ্রাতাদের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহই একমাত্র বহুপতি গ্রহণের দুষ্টান্ত নয়। কালান্তরে গৌতম বংশীয় জটিল সাতটি ঋষিকে এক সঙ্গে বিবাহ করেছিলেন। আবার বাক্ষী নামে অপর এক ঋষিকন্যা এক সঙ্গে দশভাইকে বিবাহ করেছিলেন। বৈদিক যুগে আমরা দেখেছি যে, জ্যেষ্ঠভ্রাতা কর্তৃক বিবাহিতা বধুর উপর সকল ভ্রাতার এক সঙ্গেই যৌনাধিকার থাকতো। বহুপতি গ্রহণ যে এক সময় ব্যাপক ছিল তা আমরা ব্যাসের এক উক্তি থেকেও বুঝতে পারি। দ্রৌপদীর বিবাহকালে ব্যাস বলেছিলেন “স্ত্রীলোকের পক্ষে বহুপতি গ্রহণই সনাতন ধর্ম।” ধর্মসূত্র সমূহেও এর উল্লেখ আছে। আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে “কন্যাকে কোন বিশেষ ভ্রাতার হাতে দেওয়া হয় না, ভ্রাতৃবর্গের হাতে দেওয়া হয়।” বৃহস্পতি এর প্রতিধ্বনি করেছেন, তবে তার সময়ে এরূপ বিবাহ বিরূপদূষ্টিতে দেখা হতো। পরবর্তীকালের স্মৃতিকাররা অবশ্য পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, “এক স্ত্রীর বহু স্বামী থাকতে পারে না।”
প্রাচীনকালে যৌনবাসন চরিতার্থ করা ছাড়া, বিবাহের পরম উদ্যে ছিল বংশরক্ষার জন্য সন্তান উৎপাদন করা। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “পুত্রার্থে ক্রীয়তে ভাৰ্যা” অর্থাৎ পুত্র উৎপাদনের জন্যই ভাৰ্যাগ্রহণ করা হয়। সেজন্য স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই চরম আকাজক্ষ থাকতো সম্মান লাভ করা। জরৎকারুমুনি যখন বহু বৎসর তপস্যায় নিযুক্ত থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করছিলেন, তখন তার সামনে র্তার পূর্বপুরুষরা আবিভূত হয়ে তাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “বৎস, ব্রহ্মচর্য পরিহার কর । বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন কর। তাতে আমাদের অশেষ মঙ্গল হবে।” এই কারণে বহুপুত্র লাভই সকলের চরম আকাজক্ষা হতো। অগস্ত্য যখন বিদর্ভ রাজকন্যা লোপামুদ্রাকে বিবাহ করেছিলেন, তখন তিনি তাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “প্রিয়ে, তোমার অভিলাষ বল, তুমি আমা-দ্বারা কতগুলি সন্তানের জননী হতে চাও, একটি, না একশত, না এক সহস্ৰ ।” এ সম্পর্কে মহাভারতে বর্ণিত মহাতপামুনির কন্যা শুভ্রার কাহিনীও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বহুবর্ষ তপস্যার পর শুভ্র যখন স্বর্গে যেতে চাইলেন, নারদ তখন তার সামনে এসে তাকে বললেন যে, “অনুঢ়া কন্যা কখনও স্বর্গে যেতে পারে না।” তাই শুনে শুভ্রা গালবমুনির পুত্র প্রাকশৃঙ্গকে বিবাহ করেন। মোট কথা, মহাভারতীয় যুগে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক। যথাসময়ে পুত্র-কন্যার বিবাহ দেওয়ার উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হতো। আমরা দেখতে পাই যে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিচ্ছেন, “পুত্র বিবাহের বয়স প্রাপ্ত হলেই, পিতার কর্তব্য তার বিবাহ দেওয়া ।” অপর এক স্থানে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, যে ব্যক্তি উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে যথাসময় কন্যার বিবাহ দেয় না, সে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হত্যার পাপে লিপ্ত হয়।
বিবাহের পূর্বে মেয়েদের যৌনসংসর্গ মহাভারতীয় যুগে অমুমোদিত হতো। বোধ হয় আগেকার যুগেও হতো। কেন-না ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা দেখতে পাই যে মহর্ষি সত্যকামের মাতা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। মহাভারতে এরূপ সংসর্গের দৃষ্টান্ত স্বরূপ সত্যবতী পরাশরের কাহিনী বিবৃত করা যেতে পারে। উপরিচর বস্তুব কুমারী কন্যা সত্যবতী যৌবনে যমুনায় খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। একদিন পরাশরমুনি তার নৌকায় উঠে তার অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করলেন । সত্যবতী তখন পরাশরকে বললেন, “নৌকার মধ্যে আমি কি ভাবে যৌনকর্মে রত হবে, কেন-না তীর হতে লোকেরা আমাদের দেখতে পাবে।” পরাশর তখন কুঙ্কটিকার সৃষ্টি করেন ও তারই অন্তরালে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত হন। এর ফলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসের জন্ম হয়েছিল। পরাশর সত্যবতীকে বর দেন যে এই সংসর্গ সত্ত্বেও সে কুমারী থাকবে। কুন্তী-ও কুমারী অবস্থায় সূর্যের সঙ্গে মিলনের ফলে পুত্র কর্ণকে প্রসব করেছিলেন। এক্ষেত্রেও দুর্বাশামুনির বরে কুন্তী র্তার কুমারীত্ব হারান নি। মাধবী-গালব উপাখ্যানেও আমরা দেখতে পাই যে, প্রতি সন্তান প্রসবের পর মাধবীর কুমারীত্ব অটুট ছিল। বিবাহের পূর্বে মেয়েদের যৌনসংসর্গ যে সমাজে বরদাস্ত হতো, তা বিবাহের পূর্বে প্রসূত সন্তানের “আখ্যা” থেকেই বুঝতে পারা যায়। কৃষ্ণ কর্ণকে বলছেন, ‘কুমারী মেয়ের ভূ-রকম সন্তান হতে পারে।’ (১) কানীন ও (২) সহোঢ়। যে সন্তানকে কুমারী বিবাহের পূর্বেই প্রসব করে তাকে বলা হয় কানীন। আর যে সস্তানকে কুমারী বিবাহের পূর্বে গর্ভে ধারণ করে বিবাহের পরে প্রসব করে তাকে বলা হয় সহোঢ়। মহাভারতের অপর এক জায়গায় ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, কুমারী যে সন্তানকে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে তাকে বলা হয় কানীন আর যে সন্তানকে বিবাহের পরে প্রসব করে তাকে বলা হয় অরোঢ়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মহাভারতীয় যুগে কুমারী কন্যার পক্ষে গর্ভধারণ করা বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল না।
মহাভারতীয় যুগে বিবাহিত নারীর পক্ষে স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গও নিন্দিত ছিল না। সুদর্শন উপাখ্যানে দেখতে পাওয়া যায় যে, অতিথির সন্তোষ বিনোদনের জন্য গৃহের গৃহিণীর পক্ষে অতিথির নিকট আত্মদেহ নিবেদন করা প্রচলিত রীতি ছিল। সন্তান উৎপাদনের জন্যও স্বামী ব্যতীত অপর পুরুষের সহিত যৌনমিলনের রীতিও ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর এই ধরনের যৌন মিলনতে ঘটতোই, স্বামী জীবিত থাকাকালীনও যে এরূপ মিলন ঘটতো তারও দৃষ্টান্ত আছে। স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্র উৎপাদনের জন্য অপরের সহিত যৌন মিলনের দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পাবে যে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর মাতা সত্যবতী ভীষ্মকে ভ্রাতৃজায়াদ্বয় অম্বিকা ও অস্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ভীষ্ম যখন এর অনুমোদন করলেন না, তখন তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য ব্যাসকে আহবান করা হয়। ব্যাস অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে দুটি সন্তান ও তাদের দাসীর গর্ভে আর একটি সন্তান উৎপাদন করেন। শতশৃঙ্গ পর্বতের নির্জনে পাণ্ডু কুন্তীকে আদেশ করেছিলেন, “তুমি, অপরের সহিত সঙ্গম করে সন্তান উৎপাদনের চেষ্টা কর, কেন-না শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে প্রয়োজন হলে নারী তার দেবরের সহিত মিলিত হয়ে সস্তান উৎপাদন করতে পারে।” কুন্তীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য ধর্মকে আহবান করা হয়েছিল। ধর্মের সহিত কুন্তীর সঙ্গমের ফলে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়েছিল। পরে পাণ্ডুর ইচ্ছানুক্রমে কুন্তী বায়ু ও ইন্দ্রকে আহবান করে ভীম ও অজুনকে উৎপাদন করান। পাণ্ডুর অপর স্ত্রী মাদ্রীও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সহিত মিলিত হয়ে দুটি সন্তান নকুল ও সহদেবকে উৎপাদন করিয়েছিলেন। ইম্ফাকুবংশীয় রাজা কলমাশপাদের স্ত্রীর গর্ভে বশিষ্ঠ একটি সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। নমস্ত ঋষিপত্নীরাও এরূপ যৌন সংসর্গ বা যৌন আকাজক্ষা থেকে মুক্ত ছিলেন না। কথিত আছে যে মাতিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথকে নিজ স্ত্রীগণের সহিত নদীতে যৌনকেলি করতে দেখে জামদগ্ন ঋষির স্ত্রী রেণুকা রাজার প্রতি অত্যন্ত কামাতুর হয়ে উঠেছিলেন।