আচার অনুষ্ঠানগত বিবাহ যখন প্রচলিত হলো, তখন এইরকম বিবাহের উপরই জোর দেওয়া হলো । সেজন্য আমরা দেখতে পাই যে ভৃগু যখন পুলোমাকে বিবাহ করলেন, তখন এক রাক্ষস এসে দাবী করে বললে যে, পুলোমাকে সে-ই আগে বিবাহ করেছে। এই বিবাহের মীমাংসার জন্ত অগ্নিকে সাক্ষী মানা হলো। অগ্নি রাক্ষসকে বললেন–রাক্ষস, এ কথা সত্য বটে যে তুমিই পুলোমাকে প্রথম বিবাহ করেছে, কিন্তু যেহেতু তুমি মন্ত্রপাঠদ্বারা তাকে বিবাহ কর নাই, আর ভৃগু তাকে মন্ত্রপাঠ দ্বারা বিবাহ করেছে, সেইহেতু পুলোমা ভৃগুর স্ত্রী। অপর একস্থলে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—একমাত্র যজ্ঞ সম্পাদন, মন্ত্রপাঠ ও সপ্তপদীগমন দ্বারাই বিবাহ নিম্পন্ন হয়।
আগেই বলা হয়েছে যে গান্ধৰ্ব বিবাহে এ সকল আচার অনুষ্ঠানের কোন বালাই ছিল না। সেজন্য মনে হয় যে গান্ধৰ্ব বিবাহ পূর্ববর্তীসমাজের বিবাহ । গান্ধৰ্ব ও রাক্ষস বিবাহ সম্পর্কে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে যে কথা বলেছিলেন তা থেকেও মনে হয় যে পূর্ববর্তীকালের ক্ষত্রিয় সমাজে অনুষ্ঠানগত বিবাহের প্রাধান্ত ছিল না। রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে বলছেন—“প্রিয়ে, তুমি আমাকে স্বামীরূপে বরণ কর। তুমি আমাকে গান্ধৰ্ব মতে বিবাহ কর। কেননা, শাস্ত্রকাররা বলেছেন যে, গান্ধৰ্ব বা রাক্ষস মতে বা উভয় মতের সংমিশ্রণে বিবাহই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রশস্ত ।”
রাক্ষস বিবাহে কন্যাকে বলপূর্বক কেড়ে এনে বিবাহ করা হতো। এরূপ বিবাহের অনেক উল্লেখ মহাভারতে আছে। যথা—কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বলপূর্বক হরণ করে এনে বিবাহ করেছিলেন। দেবকের রাজসভা থেকে দেবকীকে শিনি বলপূর্বক অধিকার করে এনেছিলেন বসুদেবের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য। অনুরূপভাবে দুর্যোধনের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্ত কলিঙ্গ-রাজার সভা থেকে চিত্রাঙ্গদাকে কৰ্ণ বলপূর্বক লুণ্ঠন করে এনেছিলেন। রৈবতকে থাকাকালীন অজুন যখন কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রার প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন, কৃষ্ণ তখন অজুনকে বলেছিলেন, “ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বয়ম্বরই প্রশস্ত বিবাহ । কিন্তু যেহেতু সুভদ্রা কা’কে মাল্যদান করবে তা জানা নেই, সেইহেতু আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, তুমি তাকে বলপূর্বক অধিকার করে নিয়ে যাও। শাস্ত্রকাররা বীরের পক্ষে এরূপ বিবাহ সম্মানজনক বলেছেন।” এই কথা শুনে অজুন সুভদ্রাকে বলপূর্বক হরণ করে এনে বিবাহ করেছিলেন। অজুনের এই আচরণে যাদবরা যখন ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, কৃষ্ণ তখন তাদের এই বলে সাস্তুনা দিয়েছিলেন, “আমরা যে অর্থের বিনিময়ে কন্যা বিক্রয় করি, অজুনের পক্ষে এরূপ চিন্তা কল্পনার বাইরে, স্বয়ম্বর বিবাহে অজুন সম্মত নয়, সেজন্য অজুন বলপূর্বক সুভদ্রাকে বিবাহ করেছে।” কৃষ্ণের এই উক্তি থেকে আরও প্রকাশ পাচ্ছে যে যাদবসমাজে কন্যাপণ গ্রহণের (আস্থর বিবাহের ) প্রচলন ছিল ।
আস্থর বিবাহের দৃষ্টান্ত আমরা মহাভারতের আরও অনেক জায়গায় পাই। পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য মাদ্রীকে তো মদ্ররাজ শল্যের কাছ থেকে বহু মূল্যবান জিনিসের বিনিময়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভৃগুমুনির ছেলে রিচিক যখন কান্তকুজরাজ গাধীর পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন, গাধী তখন বলেছিলেন, “আমাদের বংশের রীতি অনুযায়ী কন্যার মূল্য বাবদ তোমাকে এক হাজার তেজস্বী ঘোড়া দিতে হবে।” যযাতির মেয়ে মাধবীকে পাবার জন্যও গালবকে চার সহস্ৰ অশ্বপণ দিতে হয়েছিল। মহাভারতের অন্যত্র উল্লিখিত হয়েছে যে অঙ্গদেশে কন্যাপণ দিয়ে বিয়ে করাই প্রচলিত রীতি ছিল ।
মহাভারতীয় যুগে বিধবা ও সধবা এই উভয় অবস্থাতেই কন্যার দ্বিতীয় বার বিবাহ সম্ভবপর ছিল। এরূপ কন্যাকে পূণভূ বলা হতো। ঐরাবত তুহিতার স্বামী যখন গরুড় কর্তৃক নিহত হন তখন অজুন তাকে বিবাহ করে তার গর্ভে ইরাবন নামে এক সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে গৌতম ঋষি যখন জনৈক নাগরিকের গৃহে ভিক্ষার্থে এসেছিলেন, তখন তাকে ভিক্ষাস্বরূপ এক শূদ্র বিধবাকে দান করা হয়েছিল। গৌতম তাকে বিবাহ করে, তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন । সধবার পক্ষে দ্বিতীয়বার বিবাহ প্রয়াসের দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে নলের কোন সংবাদ না পেয়ে দময়ন্তী দ্বিতীয়বার স্বয়ম্বর হবার চেষ্টা করেছিলেন।
মহাভারতীয় যুগে বিবাহ যদিও সবর্ণে হতো, তথাপি অসবর্ণ বিবাহের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রকন্যাকে বিবাহ করার দৃষ্টান্ত একটু আগেই দেওয়া হয়েছে। তবে উচ্চবর্ণের কন্যার সঙ্গে নীচবর্ণের পুরুষের বিবাহ বিরূপদ্ধৃষ্টিতে দেখা হতো। এরূপ বিবাহকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হতো। এই কারণে ব্রাহ্মণ কন্যার সহিত শূদ্র পুরুষের বিবাহের ফলে যে সন্তান উৎপন্ন হতো তাকে চণ্ডাল বলা হতো এবং তার স্থান ছিল সমাজে সকল জাতির নীচে । একমাত্র অনুলোম বিবাহ, তার মানে উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নীচ বর্ণের কন্যার বিবাহই বৈধ বলে গণ্য হতো।
বহুপত্নী গ্রহণও মহাভারতীয় যুগে বেশ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মহাভারতের অনেক নায়কেরই একাধিক স্ত্রী ছিল। যেমন : যযাতি বিবাহ করেছিলেন শৰ্মিষ্ঠা ও দেবযানীকে, দুষ্মন্ত বিবাহ করেছিলেন শকুন্তলা ও লক্ষ্মণাকে, শান্তনু বিবাহ করেছিলেন সত্যবতী ও গঙ্গাকে, বিচিত্রবীর্য বিবাহ করেছিলেন অম্বিক ও অস্বালিকাকে, ধৃতরাষ্ট্র বিবাহ করেছিলেন গান্ধারী ও বৈষ্ঠাকে, পাণ্ড বিবাহ করেছিলেন কুন্তী ও মাদ্রীকে এবং যুক্ত-স্ত্রী হিসাবে দ্রৌপদী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ভীম বিবাহ করেছিলেন হিরিস্বাকে এবং অজুন বিবাহ করেছিলেন উলুপী, চিত্রাঙ্গদ ও সুভদ্রাকে । মগধের রাজা বৃহদ্রথও বিবাহ করেছিলেন কাশীরাজার দুই যমজ কন্যাকে । মহাভারতের একস্থলে উল্লিখিত হয়েছে যে কৃষ্ণের ১০১৬ স্ত্রী ছিল আবার অপরস্থলে বলা হয়েছে যে কৃষ্ণের ১৬,০০০ স্ত্রী ছিল। মহাভারতে আরও উল্লিখিত হয়েছে যে রাজা সোমকের একশত স্ত্রী ছিল ।