মহাভারতীয় যুগে আমরা চার রকম বিবাহের উল্লেখ পাই। ব্রাহ্ম, গান্ধৰ্ব, আমুর ও রাক্ষস । এর মধ্যে মাত্র ব্রাহ্ম বিবাহেই মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হতো। বাকী তিন রকম বিবাহ-এ সবের কোন বালাই ছিল না। আবার যাজ্ঞবল্ক্য ও মনুস্মৃতিতে আমরা আট রকম বিবাহের উল্লেখ পাই । এই আট রকম বিবাহ যথাক্রমে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আস্থর, গান্ধৰ্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। ব্রাহ্ম বিবাহ ছিল ব্রাহ্মণ্য আচারসম্পূত বিবাহ। এই বিবাহে মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে স্ববস্ত্রা, সালংকর ও সুসজ্জিত কন্যাকে বরের হাতে সম্প্রদান করা হতো। প্রাচীন ঋষিদের মধ্যে যে বিবাহ প্রচলিত ছিল, তার নাম ছিল আর্য বিবাহ । এই বিবাহে যজ্ঞে ব্যবহৃত ঘৃত প্রস্তুতের জন্য মেয়ের বাবাকে, বর এক জোড়া গামিথুন উপহার দিত। যজ্ঞের ঋত্বিককে দক্ষিণ হিসাবে যেখানে কন্যাদান করা হতো, তাকে বলা হতে দৈব বিবাহ। “তোমরা দুজনে যুক্ত হয়ে ধর্মাচরণ কর” এই উপদেশ দিয়ে যেখানে বরের হাতে মেয়েকে দেওয়া হতো, তাকে বলা হতো প্রাজাপত্য বিবাহ। বলা বাহুল্য যে এই চার রকম বিবাহপদ্ধতিরই কৌলীন্য ছিল। বাকীগুলির কোন কৌলীন্য ছিল না, কেননা সেগুলি প্রোগ বৈদিক আদিবাসী সমাজ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তার প্রমাণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে সেগুলি আদিবাসী সমাজে এখনও প্রচলিত আছে। আস্থর বিবাহ ছিল পয়সা দিয়ে মেয়ে কেনা। তার মানে যে বিবাহে কন্যাপণ দেওয়া হয়। এরূপ বিবাহে মেয়ের বাবাকে কিংবা তার অভিভাবককে পণ বা মূল্য দিতে হতো। আর মেয়েকে জোর করে কেড়ে নিয়ে বিবাহ করা হতো, তার নাম দিল রাক্ষস বিবাহ। আর যেখানে মেয়েকে অজ্ঞান বা অচৈতন্য অবস্থায় হরণ করে এনে বা প্রবঞ্চনা অথবা ছলনার দ্বারা বিবাহ করা হতো, তাকে বলা হতে পৈশাচ বিবাহ। আর নির্জনে প্রেমালাপ করে যেখানে স্বেচ্ছায় মাল্যদান করা হতো তাকে বলা হতো গান্ধৰ্ব বিবাহ। যদিও যাজ্ঞবল্ক্য ও মনু এই আট রকম বিবাহের কথা উল্লেখ করেছেন, তথাপি মহাভারতীয় যুগে উচ্চবর্ণের মধ্যে মাত্র দু-রকমের বিবাহই সাধারণত অনুষ্ঠিত হতো। তা হচ্ছে ব্রাহ্ম ও গান্ধৰ্ব । ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধৰ্ব বিবাহই ছিল প্রশস্ত। মহাভারতের নায়কদের মধ্যে অনেকেই গান্ধৰ্ব মতে বিবাহ করেছিলেন। যথা ; গঙ্গার সঙ্গে শাস্তমুর বিবাহ এইভাবেই নিম্পন্ন হয়েছিল। এইভাবেই আবার নিম্পন্ন হয়েছিল ভীমের সঙ্গে হিরিস্কার বিবাহ, অজুনের সঙ্গে উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার বিবাহ, কুষ্মস্তের সঙ্গে শকুন্তলার বিবাহ ও ইক্ষাকুবংশীয় পরীক্ষিতের সঙ্গে স্থশোভনার বিবাহ। তবে রাজারাজরার ঘরের মেয়েদের পক্ষে স্বয়ম্বর প্রথায় বিবাহ ছিল আদর্শ। স্বয়ম্বর বিবাহ ছিল রাক্ষস বিবাহেরই একটা স্থঠু সংস্করণ মাত্র। রাজারাজরাদের মধ্যে স্বয়ম্বর প্রথায় বিবাহই যে প্রশস্ত ছিল, তা আমরা কাশীরাজার তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকার স্বয়ম্বরসভায় ভীষ্মের উক্তি থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারি। ঐ সভায় ভীষ্ম বলেছিলেন, “স্মৃতিকাররা বলেছেন যে স্বয়ম্বর সভায় প্রতিদ্বন্দীদের পরাহত করে কন্যা জয় করাই ক্ষত্রিয়দের পক্ষে শ্রেষ্ঠ বিবাহ।” অনুরূপভাবে পাণ্ডব-ভ্রাতার দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদীকে স্বয়ম্বর সভায় জয় করেছিলেন। একথা এখানে বলা প্রয়োজন যে স্বয়ম্বর সভায় প্রতিদ্বন্দিতা করবার জন্য যে মাত্র আর্যকুলের রাজারাই যোগ দিতেন, তা নয়। অনার্য রাজারাও যোগ দিতেন। কেননা এরূপ স্বয়ম্বর সভা থেকেই নিষাদ-রাজ নল বিদর্ভরাজার মেয়ে দময়ন্তীকে জয় করেছিলেন। মহাভারতীয় যুগে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে যে পরস্পর বিবাহের আদান-প্রদান ঘটতে সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণ কর্তৃক নিষাদ কন্যাকে বিবাহের
উল্লেখ মহাভারতের একাধিক জায়গায় আছে। মহাভারতের অপর এক জায়গায় উল্লিখিত হয়েছে যে জনৈক ব্রাহ্মণ “পক্ষী” জাতির এক মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। এখানে ‘পক্ষী’ জাতি বলতে পক্ষী টটেম বিশিষ্ট কোন অনার্যজাতিই বোঝাচ্ছে। মহাভারতীয় যুগে রাজারাজরারাও অনার্য সমাজ থেকে স্ত্রী গ্রহণ করতে সঙ্কুচিত হতেন না। শান্তনু তো অনার্য দাসকন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেছিলেন । রাজা দেবক-ও এক অসবর্ণ শূদ্র কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন।
এরূপ সন্দেহ করবার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে মহাভারতীয় যুগের সমাজের প্রথম অবস্থায় বিবাহ সম্পাদন করবার জন্ত যজ্ঞ নিম্পাদন, মন্ত্র উচ্চারণ, সপ্তপদীগমন ইত্যাদি বিধিসম্মত কোন পদ্ধতির প্রয়োজন হতো না। পরবর্তীকালের সমাজেই এগুলি প্রবর্তিত হয়েছিল। দ্রৌপদীর বিবাহ কাহিনী থেকে এটা আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি। পাণ্ডব-ভ্রাতারা দ্রৌপদীকে জয় করে এনে কিছুকাল র্তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করেছিলেন। পরে তারা আবার দ্রুপদ রাজার গৃহে ফিরে গিয়েছিলেন যজ্ঞ সম্পাদন ও আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য। মনে হয়, পরবর্তীকালের রীতিনীতি ও প্রথার সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্যই মহাভারতের মধ্যে এই অংশটি উত্তরকালে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য আচারসম্পূত বিবাহই যে কালক্রমে প্রাধান্ত লাভ করেছিল, তা আমরা নারদ-পৰ্বত-শৃঞ্জয় উপাখ্যান, ভৃগু-পুলোমা উপাখ্যান প্রভৃতি থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পাবি। মনে হয়, পরবর্তীকালে যখন যজ্ঞ সম্পাদন, মন্ত্র উচ্চারণ ও সপ্তপদীগমন ছাড়া অনুষ্ঠানগত বিবাহ হতে পারতো না, তখনই মহাভারতের মধ্যে এই অংশগুলি প্রবেশ করানো হয়েছিল।