ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এক স্তোত্র থেকে বোঝা যায় যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা দেবরের সঙ্গেই স্ত্রীরূপে বাস করতো। সেখানে বিধবাকে বলা হচ্ছে, “তুমি উঠে পর, যে দেবু তোমার হাত ধরছে তুমি তারই স্ত্রী হয়ে তার সঙ্গে বসবাস কর।” অথর্ববেদের এক স্তোত্রেও (১০৩১-২ ) অনুরূপ কথা ধবনিত হয়েছে।
ভাবীর সঙ্গে দেবরের যে যৌন ঘনিষ্ঠত থাকতো তা ঋগ্বেদের বিবাহ সম্পর্কিত স্তোত্রও ইঙ্গিত করে। উক্ত স্তোত্রে দেবতাগণের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, তারা যেন নববধূকে দেবুর প্রিয় ও অনুরাগের পাত্রী করে তোলেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অপর এক স্থানেও বর্ণিত রয়েছে যে, বিধবা ভাবী দেবুকে র্তার দাম্পত্য শয্যায় নিয়ে যাচ্ছেন।
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে ঋগ্বেদের যুগে ভাবীর সঙ্গে দেবরের যৌন সম্পর্ক ছিল কেন। আর্যরা যখন এদেশে আসেন তখন র্তারা তাদের সঙ্গে খুব কমসংখ্যক মেয়েছেলে নিয়ে এসেছিলেন । র্তাদের মধ্যে মেয়েছেলের অভাব বিশেষভাবেই ছিল। এদেশে আসবার পর তারা এদেশের অধিবাসীদের খুব ঘৃণার চক্ষে দেখতেন । রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্ত, গোড়ারদিকে তারা এদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে কোনরূপ বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করেন নি। পরবর্তীকালে অবশ্য র্তারা এদেশের মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন । কিন্তু অস্তবর্তীকালে তাদের মধ্যে বিবাহযোগ্য মেয়ের অভাবের দরুন মাত্র জ্যেষ্ঠভ্রাতাই বিবাহ করতেন আর অন্য ভ্রাতারা ভাবীর সঙ্গেই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন।
ভাবীর উপর দেবরের এই যৌন অধিকার যে পরবর্তীকালের নিয়োগপ্রথা থেকে স্বতন্ত্র সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই। বৈদিক যুগে দেবরের যে যৌন অধিকার থাকতে তা সাধারণ রমণের অধিকার। আর পরবর্তীকালের নিয়োগপ্রথা ছিল মাত্র সন্তান উৎপাদনের অধিকার। সন্তান উৎপন্ন হবার পর এ অধিকার আর থাকতো না। আরও লক্ষ্য করবার বিষয় হচ্ছে এই যে, বিধবা ভাবীর উপর দেবরের এই যৌন অধিকার জ্যেষ্ঠের মৃত্যুর পরেও অবিকৃত থাকার দরুন ঋগ্বেদে বিধবা বিবাহের কোন উল্লেখ নেই, যা পরবর্তীকালের গ্রন্থসমূহে দেখতে পাওয়া যায়। বেদে ব্যবহৃত ও জ্ঞাতিত্ব বাচক কয়েকটি শব্দ থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকতো। ‘পিতা’ ও ‘জনিত পিতা’ এ দুটি শব্দ বেদে স্বতন্ত্র জ্ঞাতিবাচক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয়, শেষোক্ত শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে পিতা সন্তানের প্রকৃত জন্মদাতা আর প্রথম শব্দের অর্থ হচ্ছে অপর পিতা বা মাতার অন্ত স্বামী। একথা বলাবাহুল্য যে, প্রকৃত পিতা হতে অপর কোন পিতা মাত্র সেই সমাজেই কল্পিত হতে পারে, যে সমাজে স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকতে । বেদে ব্যবহৃত “পিতৃতম” শব্দও অনুরূপ ইঙ্গিত করে। এর অর্থ পিতাদের মধ্যে যে অগ্রণী বা অগ্রগামী ।
যে যুগের লোক দেবতাগণের বেলায় নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যেও যৌনমিলন কল্পনা করতে পারতে সে যুগে যে ভাবীর সঙ্গে দেবরের যৌনসম্পর্ক থাকবে, তা কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। ঋগ্বেদে যম-যমীর কথোপকথনে দেখা যায় যে, যমের যমজ-ভগ্নী যমী যখন যমের সঙ্গে যৌনমিলন প্রার্থনা করছে, যম তখন বলছে, যেকালে ভাই-বোনে যৌনমিলন ঘটতো সেকাল অনেকদিন অতীত হয়ে গেছে। সেখানে একথাও বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে হয়তো এমন যুগ পুনরায় আসবে যখন ভাই-বোনের মধ্যে এরূপ সংসর্গ আবার বৈধ বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া ঋগ্বেদে এরূপ অস্বাভাবিক মিলনের আরও উদাহরণ আছে, যেমন সূর্য ও উষার মিলন, অশ্বিনদ্বয় ও সূর্যার মিলন। আগেই বলা হয়েছে যে ঋগ্বেদে বিধবা বিবাহের উল্লেখ নেই। মনে হয়, অথর্ববেদের যুগে এর প্রবর্তন হয়েছিল । কেননা অর্থববেদের নবম মণ্ডলে বর্ণিত হয়েছে যে জনৈকা বিধবা মৃতস্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে, যাতে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে স্বর্গে যেতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে এক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিচ্ছেন।
পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত হয়েছে যে আর্যরা দুই বিভিন্ন স্রোতে ভারতে এসেছিলেন। যারা পঞ্চনদে এসে বসবাস সুরু করে ঋগ্বেদ রচনা করেছিলেন, তারা এসেছিলেন পরে। আর র্যার আগে এসেছিলেন র্তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশে । ( লেখক প্রণীত “বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়” দেখুন ) মনে হয় পরবর্তীকালে আগত ঋগ্বেদের আর্যদের তুলনায় তারা অনেক উদার মনভাবাপন্ন ছিলেন। সেই কারণে র্তারা এদেশে অনার্যদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেছিলেন। তারা বহুক্ষেত্রে যে শুধু অনার্য মেয়েদের বিবাহ করেছিলেন তা নয়, তারা অজ্ঞাতকুলশীল বহু ব্যক্তিকে যেমন সত্যকাম, জবাল, মহীদাস, ঐতরেয় ইত্যাদিকে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করে নিয়েছিলেন। মনে হয় অনার্য সমাজে প্রচলিত টটেম-ভিত্তিক বহির্বিবাহ গোষ্ঠী সমূহের অনুকরণে র্তারাই গোত্র প্রবর প্রভৃতি স্থষ্টি করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ঋগ্বেদীয় আর্যরা যখন পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তখন তারা তা গ্রহণ করেছিলেন ।
আর্য ও অনার্যদের মধ্যে যে মেলামেশা ঘটেছিল, তা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছিল মহাভারতের যুগে। এর ফলে অনার্যসমাজের বিবাহপদ্ধতি সমূহ আৰ্যসমাজেও স্থান পেয়েছিল। ঋগ্বেদের যুগে এক রকমের বিবাহই প্রচলিত ছিল। সে বিবাহ নিম্পন্ন হতো মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদন দ্বার। কিন্তু মহাভারতীয় যুগের সমাজে এমন সব রকমের বিবাহও স্থান পেয়েছিল, যার জন্ত মন্ত্র উচ্চারণ ব: যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হতে না ।