যুগ যুগ ধরে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশার ফলে ভারতীয় কৃষ্টি আজ নানা জাতির ছাপ বহন করছে। পরবর্তী অধ্যায় সমূহে আমরা দেখতে পাব যে এর প্রভাব বিবাহ রীতিনীতির উপরও প্রতিফলিত
হয়েছে ।
বিবাহ সমস্যার উপর যৌন অনুপাতের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যৌন অনুপাত বলতে আমরা হাজার পুরুষ প্রতি স্ত্রীলোকের সংখ্যা বুঝি। স্ত্রীলোকের সংখ্যা যেখানে কম সেখানে প্রধান সমস্যা হচ্ছে পাত্রী সংগ্রহ করা, আর যেখানে পুরুষের সংখ্যা কম সেখানে পাত্র সংগ্রহ করাই প্রধান সমস্যা দাঁড়ায় ।
গত ৭০ বৎসর পুরুষের তুলনায় ভারতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা ক্রমশ কমতে আরম্ভ করেছে। ১৯০১ খ্ৰীষ্টাব্দে হাজার পুরুষ প্রতি স্ত্রীলোকের সংখ্যা ছিল ৯৭২ জন। এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৯১১ সালে ৯৬৪ জনে, ১৯২১ খ্ৰীষ্টাব্দে ৯৫৫ জনে, ১৯৩১ খ্ৰীষ্টাব্দে ৯৫০ জনে, ১৯৪১ খ্ৰীষ্টাব্দে ৯৪৬ জনে, ১৯৬০ খ্ৰীষ্টাব্দে ৯৪১ জনে ও ১৯৫১ খ্ৰীষ্টাব্দে ৯৩২ জনে। যে দেশে বিবাহ বাধ্যতামূলক ছিল এবং বহুপত্নী গ্রহণেরও কোন অন্তরায় ছিল না, সেদেশে যে এককালে পুরুষ অপেক্ষ স্ত্রীলোকের সংখ্যাই অধিক ছিল, সেরূপ অনুমান করবার পক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে। কি কারণে গত ৭০ বৎসরকাল ভারতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, তা অনুসন্ধানের বিষয়। তবে এ সম্বন্ধে জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্যাদি আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে যদিও ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই পুরুষের অনুপাতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে তথাপি কয়েকটি রাজ্যে যেমন কেরালাপাঞ্জাব, বাজস্থান ও ত্রিপুরায় স্ত্রীলোকের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আদিবাসীদের মধ্যে পুরুষের অনুপাতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা অধিক। আরও দেখা যায় যে, উচ্চবণের জাতিসমূহ অপেক্ষ। নিম্নবর্ণের জাতিসমূহের মধ্যেও পুরুষের অনুপাতে স্ত্রীলোকের সংখ্যা বেশী। আবার শহরাঞ্চল অপেক্ষ। গ্রামাঞ্চলে স্ত্রীলোকের সংখ্য। অধিক । এর কারণ অবশ্য স্বাভাবিক। কেননা গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আগন্তুক পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশী ।
যে সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলিত নেই, সে সমাজে স্ত্রীলোকের অনাধিক্য বিবাহ সমস্যার উপর বিশেষ প্রতিক্রিয়া ঘটায়, বিশেষ করে পাত্রী সংগ্রহ সম্পর্কে । কিন্তু তার চেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া ঘটেছে, বিয়ের বয়সের পরিবর্তন হেতু। বিয়ের বয়স আগেকার দিনে খুব কমই হতো। মনুর বিধান ছিল যে বিবাহের জন্য মেয়ের বয়স আট হবে, আর ছেলের বয়স ২৪ হবে । বিয়ের বয়সের দিক থেকে স্মৃতিকাররা মেয়েদের পাচভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম “নগ্নিকা” অর্থাৎ যখন সে নগ্ন হয়ে থাকে, দ্বিতীয় গৌরী” অর্থাৎ আট বছরের মেয়ে, তৃতীয় “রোহিনী” অর্থাৎ নয় বছরের মেয়ে, চতুর্থ *কন্যা” অর্থাৎ দশ বছরের মেয়ে এবং পঞ্চম “রজস্বলা” অর্থাৎ দশ বছরের উপর বয়সের মেয়ে। যদিও মনু মেয়েদের পক্ষে আট বছর ও পুরুষদের ২৪ বছর বয়স বেঁধে দিয়েছিলেন, উত্তরকালে কার্যত এ বয়স বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেক কমে গিয়েছিল। তার ফলে হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহই প্রচলিত প্রথায় দাড়িয়েছিল। সম্প্রতি যদিও এর পরিবর্তন ঘটেছে, তথাপি কিছুদিন আগে পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িষ্যায় বাল্যবিবাহ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে উচ্চবর্ণের জাতিসমূহের মধ্যে এবং বিশেষ করে শিক্ষিতসমাজে বিবাহ আর অল্প বয়সে হয় না। আজকাল মেয়েদের বিবাহ আকছার ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে হচ্ছে । অনেকে আবার আজীবন কুমারীও থেকে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে পুরুষদের বিবাহও ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে হচ্ছে এবং তাদের মধ্যেও অনেকে অবিবাহিত থাকছে ।
বিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান প্রজনন। সেদিক থেকে মেয়েদের প্রজননশক্তির.উর্বরতার উপর বিবাহের সাফল্য ও জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে। এ সম্বন্ধে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে হিন্দুদের তুলনায়. উপজাতি সমাজের মেয়েদের উর্বরতাশক্তি অনেক কম । তাদের মধ্যে প্রায়ই স্ত্রীলোকের এক থেকে তিনের বেশী সন্তান হয় না ।
০২. প্রাচীন ভারতে বিবাহ
হিন্দুরা যদিও দাবী করে যে তাদের মধ্যে প্রচলিত বিবাহের রীতিনীতি বৈদিক যুগ থেকে অনুস্থত হয়ে এসেছে তথাপি কথাটা ঠিক নয়। গোত্র-প্রবর-সপিও বর্জন বিধি, যার উপর বর্তমান হিন্দুদের বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত, তার উল্লেখ বৈদিক যুগের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে মোটেই নেই। মনে হয়, ঋগ্বেদের যুগে বিবাহ প্রতিষ্ঠিত ছিল গ্রামভিত্তিক বহির্বিবাহের নিয়মের উপর। কেননা, ঋগ্বেদের বিবাহসংক্রান্ত স্তোত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, পাত্রপাত্রী বিভিন্ন গ্রামের সহিত সংশ্লিষ্ট হতে এবং “দিধিষু” নামে এক শ্রেণীর মধ্যগের মাধ্যমে বিবাহের যোগাযোগ সাধিত হতো। নবপরিণীত। যে অন্ত গ্রামের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকতো, তা তার বধু আখ্যা থেকেই বোঝা যায়। কেননা, “বধু’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে যাকে বহন করে আনা হয়েছে। বৈদিকযুগের বিবাহ সম্বন্ধে আরও লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, নবপরিণীতার বিবাহ কোন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে হতে না, তার সমস্ত সহোদর ভ্রাতাগণেরই সঙ্গে হতো। অন্ততঃ আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রের যুগ পর্যন্ত এই রীতি প্রচলিত ছিল। কেননা, আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে কন্যাকে দান করা হয় কোন এক বিশেষ ভ্রাতাকে নয়, বংশের সমস্ত ভ্রাতাকে। এজন্তই পরবর্তীকালে মনু বিধান দিয়েছিলেন যে কলিযুগে কন্যার বিবাহ যেন সমগ্র পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে না দেওয়া হয়। মমুর এই বিধান থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, তথাকথিত কলিপুর্বযুগে কন্যার বিবাহ সমগ্র পরিবারের সহিতই সাধিত হতো। ঋগ্বেদে এবং অথর্ববেদে এমন কয়েকটি স্তোত্র আছে যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, যদিও বধূকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই বিবাহ করতে, তা হলেও তার কনিষ্ঠ সহোদরগণেরও তার উপর যৌনমিলন বা রমনের অধিকার থাকতো। এই দুই গ্রন্থেই স্বামীর কনিষ্ঠভ্রাতাকে “দেবৃ” বা দেবর বলা হয়েছে। এই শব্দদ্বয় থেকেও তা সূচিত হয়। কেননা দেবর মানে দ্বিবর বা দ্বিতীয় বর।