এছাড়া বাংলাদেশের উচ্চবর্ণেব কোন কোন জাতির মধ্যে আরও কতকগুলি কঠিন প্রতিবন্ধক ছিল । এ সকল জাতির মধ্যে বিবাহ কোন বিশেষ শ্রেণী বা পর্যায়েব মধ্যে হওয়ার রীতি ছিল। যেমন— দক্ষিণ বাঢ়ী কুলীন কায়স্থগণের মধ্যে পুত্রেব বিবাহের জন্ত (এদের মধ্যে কৌলীন্য পুত্রগত, ব্রাহ্মণদেব মত কন্যাগত নয় ) পাত্ৰী নির্বাচন করতে হয় সমপর্যায অপব দুই কুলীন শাখা হতে।
হিন্দুসমাজে সাধারণত পাত্র অপেক্ষা পাত্ৰীব বয়স কম হয়। কিন্তু পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এই নিয়ম সব সময় পালিত হয় না। তার কারণ সেখানে “বাঞ্ছনীয়” বিবাহ প্রচলন থাকার দরুন প্রায়ই দেখা যায় যে “বাঞ্ছনীয়” পাত্রী, পাত্র অপেক্ষ বয়সে অনেক বড়। এরূপ ক্ষেত্রে বয়সেব তারতম্য দরুন অসামঞ্জস্য দোষ দূর করবার জন্য ছেলের সঙ্গে মেয়ের যত বছরের তফাৎ, মেয়ের বিয়ের সময় তার কোমরে তত সংখ্যক নারিকেল বেঁধে দেওয়া হয়।
বিবাহে সপিণ্ড এড়ানোর নিয়ম দক্ষিণ ভারতে পুর্ণ মাত্রায় পালন করা হয় না। কেননা দক্ষিণ ভারতে বহু জাতির মধ্যে পিসতুতো বোন বা মামাতো বোনকে বিবাহ করতে হয়। অনেক জায়গায় আবার মামা ভাগ্নীর মধ্যেও বিবাহ হয়। বাধ্যতামূলক না হলেও এটাই হচ্ছে সেখানে “বাঞ্ছনীয়” বিবাহ। মামাতো বোনকে বিয়ে করার রীতি অবশ্ব মহাভারতের যুগেও ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ অজু নেব সঙ্গে সুভদ্রার, শিশুপালেব সঙ্গে ভদ্রার, পরীক্ষিতের সঙ্গে ইরাবতীব বিবাহের উল্লেখ করা যেতে পারে। দক্ষিণ মারাঠাদেশে নূনপক্ষে ৩১টি জাতি আছে, যার মামাতো বোনকে বিয়ে করে। আদিবাসীদের মধ্যেও কোথাও কোথাও এরূপ বাঞ্ছনীয় বিবাহ প্রচলিত আছে। মধ্যপ্রদেশের গোণ্ড, বাইগ ও আশারিয়াদের মধ্যে পিসতুতো বোনকে বিবাহ করার প্রথা আছে। এখানে এরূপ বিবাহকে “তুধ লেীটনা” বলা হয়। তার অর্থ এই যে, মেয়ের বিয়ের জন্য কোন পরিবারের যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা পূরণ কবতে হবে অপর পরিবারকে মেয়ে দান করে। এখানে প্রসঙ্গত বলা যেতে পাবে যে আদিবাসী সমাজে স্ত্রীলোক আর্থিক সম্পদ বিশেষ, কেননা স্ত্রীলোকের পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে শ্রম করে। মারিয়া গোগুদেব মধ্যে পিসতুতো বোনকে যদি বিবাহের জন্য মামাতো ভাইয়ের হাতে না দেওয়া হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত হস্তক্ষেপ করে এবং জোব করে দুজনের মধ্যে বিবাহ দিয়ে দেয়। সিকিমেব ভুটিয়ারা মাতৃকুলে বিবাহ করে। কিন্তু পিসির কুলে কখনও বিবাহ করে না। হে ও সাঁওতালদের মধ্যে পিসতুতো-মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহের একটা বৈশিষ্ট্যমূলক নিয়ম আছে। এদের মধ্যে মামা যতদিন জীবিত থাকে ততদিন মামার মেয়েকে বিয়ে করা চলে না। অনুরূপ
ভাবে পিসি যতদিন জীবিত থাকে ততদিন পিসির মেয়েকেও বিবাহ করা যায় না।
যদিও বর্তমানে একৃপত্নীত্বই একমাত্র আইনসিদ্ধ বিবাহ বলে পরিগণিত হয়েছে তা হলেও কিছুকাল আগে পর্যন্ত হিন্দু সমাজে বহুপত্নী গ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতে বহুপতি গ্রহণও প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বহুপতিগ্রহণ প্রচলিত আছে দক্ষিণ ভারতে টোডাদের মধ্যে ও উত্তর ভারতে খসজাতির মধ্যে। বহুপতিক বিবাহ দুরকমের হতে পারে। যেখানে স্বামীরা সকলেই সহোদর ভাই, সেখানে এরূপ বিবাহকে ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিক বিবাহ বলা হয়। যেখানে স্বামীরা সকলে ভাই নন, সেখানে তাকে অভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিক বিবাহ বলা হয়। উত্তর ভারতের খস্জাতির মধ্যে ও দক্ষিণ ভারতে টোডাদের মধ্যে যে বর্গের বহুপতিক বিবাহ প্রচলিত আছে, তা ভ্রাতৃত্বমূলক। আবার মালাবারের নায়ারদের মধ্যে ও উত্তরে তিববতীয়দের মধ্যে যে বর্গের বহুপতিক বিবাহ প্রচলিত আছে, তা অভ্রাতৃত্বমূলক। এ সকল ক্ষেত্রে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ণীত হয় এক সামাজিক অনুষ্ঠানের দ্বারা। আবার অনেকস্থলে দেবর কর্তৃক বিধবা ভাবীকে বিবাহ করার রীতিও আছে। এরূপ বিবাহকে দেবরণ বলা হয় । আবার অনুরূপভাবে যেখানে স্ত্রীব ভগিনীদের বিবাহ করা হয় তাকে শালীবরণ বলা হয়। বর্তমানে বহু জাতির মধ্যে এরূপ বিবাহের প্রচলন আছে। এক সময় বাংলাদেশেও প্রচলিত ছিল।
ভারতে বিবাহ প্রথার বিচিত্রতার কারণ হচ্ছে, নানাজাতি ও কুষ্টির সমাবেশ। অতি প্রাচীনকাল থেকে নানা জাতিব লোক এসে ভারতের জনস্রোতে মিশেছে। তার ফলে, ভারতে নানা নরগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটেছে। এদের মধ্যে আছে, অষ্ট্রালয়েড বা প্রাক্দ্রাবিড়, দ্রাবিড়, আর্য ও মঙ্গোলীয়। অষ্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর লোকেরাই হচ্ছে ভারতের আদিবাসী। তারা আজ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে মধ্য ভারতে ।
১৯৬০ সালে লোক গণনার সময় এদের সংখ্যা ছিল ২,৯৮,৮৩,৪৭০ জন। ভারতের সমগ্র জনবাসীর ৬-৮৬ শতাংশ। আদিবাসীরা সাধারণতঃ অষ্ট্রএশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তভুক্ত দুই প্রধান শাখার ভাষা সমূহে কথাবার্তা বলে। এই দুই প্রধান শাখা হচ্ছে মুণ্ডারী ও মন্খেমর। ছোট নাগপুরের আদিবাসীরা মুণ্ডারী ভাষাগোষ্ঠীর অন্তভুক্ত ভাষাসমূহে কথাবার্তা বলে। এর উপশাখা সমূহ হচ্ছে থারওয়ারী, কোরফা, খরিয়া, জুয়াঙ, শবর ও গডব। আবার থারওয়ারীর অন্তভুক্ত হচ্ছে সাঁওতালী, হর, ভূমিজ, কোরা, হো, তুরিম, আমুরী, আগারিয়া ও কোরওয়া। সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে সাঁওতাল পরগণার অধিবাসীরা । বাকীগুলি প্রচলিত আছে ওড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের নানা উপজাতির মধ্যে। দক্ষিণ ভারতের আদিবাসীরা দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলে। তার অন্তভুক্ত হচ্ছে কোডাগু, তুলু, টোডা ও কোটা। তবে ছোটনাগপুরের ওরাওরাও দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলে। এরূপ অনুমান করবার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে আগন্তুক জাতিসমূহের মধ্যে দ্রাবিড় জাতিই প্রথম ভারতে এসে বসবাস সুরু করে এবং তার অনেক পরে আসে আর্যরা। আর্যরা এসে বসবাস সুরু করে পঞ্চনদ উপত্যকায় এবং পরে ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর উপত্যকায়। র্তারাই ভারতে বৈদিক সংস্কৃতির প্রবর্তন করেন এবং বর্ণাশ্রম ধর্ম ও জাতিভেদের স্বষ্টি করেন। দ্রাবিড় জাতি বর্তমানে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে দক্ষিণ ভারতে আর মঙ্গোলীয় জাতি সমূহ বাস করে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে।