এক বিবাহ বিচ্ছেদের সময় থেকে নুতন অপর বিবাহের মধ্যবর্তীকালীন অপেক্ষা করবার সময় ।
আদালতের সাহায্য ব্যতিরেকে মুসলিমসমাজে সহজে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্পর্কে প্রথাগত রীতি অনুযায়ী ছ’রকম
পদ্ধতি আছে। প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে “তালাক” উচ্চারণ করে দাম্পত্য সম্পর্কের ছেদ ঘটানো। যদি “তালাক” একবার উচ্চারণ করা হয় তাহলে তালাকের পর “ইন্দত” পালন করতে হয়। আর এক রকমের “তালাক” হচ্ছে স্ত্রীলোকের ক্রমান্বয় তিনটি “তুড়”-এর (মাসিক ঋতু) সময় তিনবার পতালাক” উচ্চারণ করা। তবে প্রত্যাহার না করবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে একই সঙ্গে তিনবার “তালাক” উচ্চারণ করা যেতে পারে। “তালাক” উচ্চারণের সময় কোন সাক্ষী বা স্ত্রীর উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না স্ত্রী নেপথ্যে থাকলেও “তালাক” দেওয়া যেতে পারে। বিবাহ-বিচ্ছেদের দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে “ইলা” । “ইলা” হচ্ছে ব্রত গ্রহণ করে চারমাস স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম না করা । তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে “জিহার” । “জিহার” হচ্ছে স্বামী যদি বিবাহের জন্ত সম্পর্কিত কোন আত্মীয়ার নাম উচ্চারণ করে তাহলে স্ত্রী তাকে “তালাক” উচ্চারণ করতে বাধ্য করাতে পারে। স্বামী যদি অস্বীকৃত হয় তাহলে স্ত্রী আদালতে গিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করতে পারে। চতুর্থ পদ্ধতি হচ্ছে “খোলা”। যেখানে স্ত্রী স্বামীকে রাজী করিয়ে এবং তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায় সেখানে বিবাহ-বিচ্ছেদকে “খোলা” বলা হয়। পঞ্চম পদ্ধতিকে “মুবারত” বলা হয়। “মুবারত” হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতিক্রমে বিবাহ-বিচ্ছেদ। “মুবারতে”র সঙ্গে “খোলা”-র প্রভেদ হচ্ছে এই যে, “খোলা” পদ্ধতিতে স্ত্রী-ই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায় আর “মুবারত” পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায়। বিবাহবিচ্ছেদের ষষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে “তালাক-ই তাফ যুজ”। এ ক্ষেত্রে স্বামী দ্বারা আদিষ্ট হয়ে স্ত্রী-ই “তালাক” উচ্চারণ করে।
আদালতের আশ্রয় নিয়েও মুসলিমসমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্বন্ধে ১৯৩৯ সালে মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ২নং ধারায় যে সকল কারণে আদালতকে বিবাহ-বিচ্ছেদ গ্রাহ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে
তার মধ্যে আছে :
(১) চার বৎসর যদি স্বামীর কান খোঁজ-খবর না না পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আদালতের রায় ছ’মাসের জন্য মুলতুবী রাখা হয় এবং ওই সময়ের মধ্যে স্বামী যদি প্রত্যাবর্তন করে তাহলে ওই রায় বাতিল হয়ে যায়।
(২) দু বৎসর যদি স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণে অমনযোগী হয়।
(৩) সাত বা ততোধিক বৎসরের জন্য যদি স্বামীর কারাদণ্ড হয়।
(৪) তিন বৎসর যদি স্বামী তার দাম্পত্যধর্ম না পালন করে।
(৫) স্বামী যদি নপুংশক হয়। এক্ষেত্রে তার প্রজননশক্তি প্রমাণ করবার জন্য স্বামীকে এক বৎসরের জন্য সময় দেওয়া হয়।
(৬) দু বৎসর ব্যাপী স্বামী যদি উন্মাদ রোগাক্রান্ত হয়।
(৭) স্বামী যদি কুষ্ঠ বা কোন কুৎসিত যৌনব্যাধিগ্রস্ত হয়।
(৮) ১৫ বৎসর বয়স উর্ত্তীর্ণ হবার আগেই যদি পিতামাতা বা অভিভাবকের সম্মতি অনুসারে তার বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রী ১৮ বৎসর উর্ত্তীর্ণ হবার পর স্বামীকে পরিহার করতে পারে।
(৯) স্বামী যদি স্ত্রীকে দৈনিক বা মানসিক কোনরূপ পীড়া দেয়।
১২. বিবাহের উপর গণতান্ত্রিক প্রভাব
সাম্প্রতিককালে হিন্দুর যৌনজীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বলাবাহুল্য পাশ্চাত্য দেশের চিন্তাধারার প্রভাবেই এটা ঘটেছে। পরিবর্তনের সূচনা হয় রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন্ত স্ত্রীকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলপূর্বক ) আহুতি দেওয়া হতো স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় । এদেশে কত অভাগিনী নারী যে এভাবে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্ত নেই। এই নিষ্ঠুর বর্বর প্রথার উচ্ছেদের জন্য রাজা রামমোহন রায় খড়গহস্ত হন। সনাতনীসমাজের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়। তিনি লর্ড ডালহাউসীকে সম্মত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ১৮২৯ সালের ২৭নং আইন বিধিবদ্ধ করাতে। এই আইনের ফলে সতীদাহ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সহমরণের হাত থেকে হিন্দু বিধবা রক্ষা পেলো বটে কিন্তু তার সামনে যে পথ উন্মুক্ত রইল সেটা হচ্ছে সারা জীবন ব্রহ্মচর্যপালন করা। খুব অল্প বয়সে যেসব মেয়ে বিধবা হতো তাদেরও বাধ্য করা হতে এই কঠোর সংযমের বশীভূত হতে। এর ফলে সমাজে নানারূপ তুনীতি প্রবেশ করেছিল। বাল-বিধবার এই কঠোর জীবনের প্রতি সৌহার্দ্য হয়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বদ্ধপরিকর হন, এই সকল অক্ষতযোনী বাল-বিধবার পুনরায় বিবাহ দেবার জন্য। সনাতনীসমাজ তাকেও রেহাই দিল না। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজকে কশাঘাত করবার শক্তির অধিকারী ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। একাই তিনি রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি প্রবুদ্ধ করলেন তৎকালীন সরকারকে ১৮৫৬ সালের ১৫নং আইন বিধিবদ্ধ করাতে। এই আইন দ্বারা বিধবার বিবাহ বৈধ করা হলো ।
তারপর ১৮৭২ সালের ৩নং আইন দ্বারা সবর্ণ বিবাহের বাধাও দূর করা হলো। তবে এই আইন অনুযায়ী বিবাহ করতে হলে বিবাহ-ইচ্ছুক উভয় পক্ষকেই শপথ করতে হতে যে, তারা হিন্দু নন। কিন্তু ১৯২৩ সালের ৩০নং আইন দ্বারা বিধান দেওয়া হলো যে, অহিন্দু বলে ঘোষণা না করেও অসবর্ণ বিবাহ করতে পারা যাবে। এরপর রায়বাহাদুর হরবিলাস সরদা বদ্ধপরিকর হলেন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহ রোধ করবার জন্ত । ১৯২৯ সালের ১৯নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হলো যে হিন্দু-বিবাহে ছেলের উপযুক্ত বয়স নূনপক্ষে ১৮ ও মেয়ের বয়স ১৫ হওয়া চাই। ১৯৩০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে চালু হয়ে এই আইন এখনও বলবৎ আছে। হিন্দু বিবাহ সংস্কারের জন্য দুটো বড় রকমের আইন বিধিবদ্ধ করা হয় ১৯৪৬ সালে। ওই বৎসর ১৯নং আইন দ্বারা স্ত্রীকে অধিকার দেওয়া হলো অবস্থাবিশেষে স্বামী ত্যাগের জন্য। স্বামী যদি কুৎসিত ব্যাধিতে ভোগেন, কী স্ত্রীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন যাতে স্ত্রীর নিরাপত্তার অভাব ঘটে, কী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন, কী আবার স্ত্রীগ্রহণ করেন, কী নিজ বাসগৃহে রক্ষিতা এনে রাখেন, কী ব্যভিচারে লিপ্ত হন, কী ধর্মান্তর গ্রহণ করেন, তাহলে ওই আইনের বলে স্ত্রী স্বচ্ছন্দে স্বামী ত্যাগ করে স্বতন্ত্র বসবাস করতে পারবেন। আর ২৮নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হলো যে, সগোত্রে ও সমপ্রবরে বিবাহও বৈধ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৯ সালের ২১নং আইন দ্বারা বিবাহক্ষেত্রে জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণীগত ও সম্প্রদায়গত যত রকম বাধা-বৈষম্য ছিল তা দূরীভূত করা হলো। বিবাহ সম্পর্কে শেষ আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এটাই হচ্ছে বিবাহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনটিকে হিন্দুবিবাহ বিধি বা ১৯৫৫ সালের ২৫নং আইন বলা হয়। বৈধ বিবাহের যে সকল শর্ত এতে নির্দিষ্ট হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঃ