গণিকা তার বৃত্তির অনুশীলন করে কেবল যে যৌনসুখ লাভ করে তা নয়, সে এর দ্বারা নিজের জীবিকাও অর্জন করে। গণিকা সুসজ্জিত ও সালস্কৃত হয়ে উপবিষ্ট থাকবে তার গৃহদ্বারে এবং নিজেকে অধিকমাত্রায় প্রকট বা প্রদর্শন না করে পথের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকবে যে জুর উপর পথচারীদের দৃষ্টি পড়বে। বারাঙ্গনাদের কী কী লক্ষণ থাকা দরকার সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তাকে সুন্দরী, মিষ্টভাষিনী ও সুলক্ষণ হতে হবে। অপরের অর্থের প্রতি যে তার লোভ থাকবে তা নয়, অপরের গুণের প্রতিও তার অনুরাগ থাকা চাই ও অপরের সঙ্গে প্রেম ও সঙ্গম করে তার আনন্দ পাওয়া চাই যেসব ব্যক্তিকে সে মনোরঞ্জনের জন্ত গ্রহণ করবে না সে সম্বন্ধেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরূপ ব্যক্তির অন্তৰ্ভুক্ত হচ্ছে, ক্ষয়রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তি, যে ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস ও মুখ থেকে পুরীষের মত দুৰ্গন্ধ নির্গত হয়, লোভী ব্যক্তি, নিষ্ঠুর ব্যক্তি, তস্কর, অধিকমাত্রায় আত্মগৰ্বী ব্যক্তি, তুকতাকে পারদর্শী ব্যক্তি, যে ব্যক্তি অপরকে সম্মান প্রদর্শন করতে জানে না, যে ব্যক্তি নিজ শত্রু দ্বারা ও অর্থের দ্বারা বশীভূত হয় এবং যে ব্যক্তি অত্যন্ত লজ্জাশীল। আগত ব্যক্তিকে কিভাবে আপ্যায়ন করবে সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে, প্রমোদকারী যখন তার গৃহে আসবে সে তখন তাকে তাম্বুল, মাল্য ও সুগন্ধ দ্রব্য দ্বারা সংবৰ্দ্ধনা করবে, তাকে শিল্পকলায় নিজের পারদর্শিতা দেখাবে, তার সঙ্গে আলাপনে নিযুক্ত থাকবে, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে উপহার বিনিময় করবে এবং যৌনকর্মে নৈপূণ্য দেখাবে। আচার্যগণ বলেন, পরিচিত প্রমোদকারীর পরিবর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রমোদকারীকেই সে সব সময় নির্বাচন করবে। আচার্যগণের এই উক্তি উদ্ধৃত করে বাৎসায়ণ বলেছেন যে, যেহেতু পরিচিত প্রমোদকারী অপেক্ষা অপরিচিত প্রমোদকারীর কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে সেই হেতু অপরিচিত প্রমোদকারীকেই তার পছন্দ করা উচিত|
গণিকাবৃত্তি হিন্দুযুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত চলে এসেছে। যদিও ইংরাজরা গণিকাবৃত্তিকে খুব আনুকুল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন না তথাপি তাঁরা এর বিলোপের কোন চেষ্টা করেন নি। তবে গণিকাবৃত্তির জন্য বিদেশী মেয়ে যাতে এদেশে না আসে তার প্রতি তাঁরা সযত্ব ছিলেন ।
বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ১৮ বৎসরের কম বয়স্ক মেয়েদের দ্বারা গণিকাবৃত্তি করানো অপরাধ। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বেশ্যালয় সংরক্ষণও অপরাধ বলে গণ্য হয়। আরও অনেক বিষয় দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করার জন্য আইন রচিত হয়েছে। এ সকল অপরাধের অন্তভুক্ত হচ্ছে—রাস্তায় বা প্রকাশ্যস্থানে দাড়িয়ে খরিদ্দার আহ্বান করা, গণিকার আয়ের উপর জীবিকা নির্বাহ করা, গণিকাবৃত্তির জন্য স্ত্রীলোক সংগ্রহ করা, অসৎ উদ্দেশ্যে স্ত্রীলোককে আটক রাখা, প্রকাশ্যস্থানে গণিকাবৃত্তির অনুশীলন করা, বেশ্যলয় রক্ষণ বা পরিচালনা করা, বেশ্যালয় হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাড়ী ভাড়া দেওয়া এবং নিষিদ্ধ অঞ্চলে গণিকাবৃত্তির অনুশীলন করা।
১১. মুসলিমসমাজে বিবাহ
মুসলিমসমাজে বিবাহ সম্পর্কে বাধানিষেধ হিন্দুসমাজের তুলনায় অনেক কম। তবে প্রথম বিবাহ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুঢ়া মেয়ের সঙ্গে হওয়া চাই। পরবর্তী বিবাহ সম্বন্ধে কোন বাধানিষেধ নেই। হিন্দুদের মত মুসলমানসমাজে কোন গোত্রবিভাগ নেই। সেই কারণে বহির্বিবাহের কোন নিয়ম-কানুনও নেই। নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কোন পুরুষ যে কোন স্ত্রীলোককে বিবাহ করতে পারে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয় না তবে বাঞ্ছনীয় বিবাহ হিসাবে খুড়তুতে, জাঠতুতে, মাসতুতে, মামাতে, পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে। এরূপ ভাই বোন থাকলে তাদের মধ্যে বিবাহই অগ্রাধিকার পায়। তা না হলে অন্ত পরিবারে বিবাহ হয়। এরূপ বিবাহের সমর্থনে বলা হয় যে, এতে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় ও সম্পত্তি অবিভক্ত অবস্থায় থাকে। তবে কোন কোন জায়গায় ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের বিরোধিতাও লক্ষিত হয়।
হিন্দুসমাজের মত মুসলিমসমাজেও বিবাহ সর্বজনীন ব্যাপার। সকলকেই বিবাহ করতে হয় এবং চিরকৌমাৰ্য কখনও উৎসাহিত করা হয় না। মুসলিমসমাজে ১৫ বৎসরের অধিক বয়স্ক যে কোন পুরুষ বিবাহ করতে পারে। অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে ১৫ বৎসরের কম বয়স্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বিবাহ চলে। মুসলিমসমাজে বিবাহে বর ও কনে উভয়েরই সম্মতির প্রয়োজন হয় এবং তা বিশেষভাবে স্পষ্টতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়। দু’জন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের সামনে বিবাহের প্রস্তাব ও স্বীকৃতি একই সময় করতে হয়। প্রতারণা বা বলপ্রয়োগ দ্বারা বিবাহ অবৈধ বলে গণ্য হয়। মুসলিমসমাজে কোন স্ত্রীলোক মুসলমান ব্যতীত অপর কাহাকেও বিবাহ করতে পারে না। তবে পুরুষরা মুসলমান ব্যতীত “কিতাবিয়া” ( ক্রীশচীন বা ইহুদী ) নারীকেও বিবাহ করতে পারে। মুসলিমসমাজে বহুপত্নী গ্রহণের কোন বাধা নেই। তবে চারটির বেশী পত্নী গ্রহণ নিয়মবিরুদ্ধ বলে ধরা হয়।
যদি বিদ্যমান সম্পর্ক অবৈধ বলে গণ্য না হয় তা হলে মুসলিমসমাজে স্ত্রী-পুরুষ যেখানে স্থায়ীভাবে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করে আসছে কিংবা পুরুষ যদি স্বীকার করে যে সে নারী তার স্ত্রী তাহলে সে সম্পর্ককে বিবাহের পর্যায়ে ফেলা হয়। ইসলামধর্মাবলম্বী কোন-কোন শাখার মধ্যে “মোতা” নামে একরকম বিবাহ প্রচলিত আছে। “মোতা” বিবাহ হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িক বিবাহ। অনেক সময় এরূপ বিবাহ মাত্র একদিনের জন্যও স্থায়ী হয়। এরূপ বিবাহে স্ত্রীধনও দেওয়া হয়। কিন্তু এরূপ বিবাহের ফলে উৎপন্ন সন্তানের কোন উত্তরাধিকার থাকে না। তবে পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করে এরূপ সন্তানের উত্তরাধিকার দেওয়া চলে। অবশ্য উত্তরাধিকার না থাকলেও সন্তানের বৈধতা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন বা বিবাদ ওঠে না। বিচ্ছেদের পর এরূপ বিবাহে স্ত্রী কোনরূপ ভরণপোষণ পায় না। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হলে বা তার পূর্বে উভয়ের মধ্যে কেউ মারা গেলে বা স্বামী যদি মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই সময়ের মকুফ করে তা হলে এরূপ বিবাহের ছেদ ঘটে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও স্ত্রীকে “ইন্দত” উদযাপন করতে হয়। মুসলিমসমাজে “ইন্দত” বলতে বোঝায়