দক্ষিণ ভারতের অপর একস্থানেও আবে দুবোয়া যে প্রথা দেখেছিলেন তার বিবরণও তিনি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, কোন কোন জনবিরল অঞ্চলে এমন অনেক মন্দির আছে যেখানে দেবতাদের প্রীতির জন্য অতি জঘন্য ধরণের লাম্পট্যের লীলা চলে। এসকল স্থানে বন্ধ্যা নারীর সবরকম লজ্জাসরম বিসর্জন দিয়ে নির্বিচারে ও নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকেদের সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়। প্রতি বৎসর জানুয়ারি মাসে এই সকল স্থানে উচ্ছৃঙ্খলতার এক উৎসব হয় এবং ওই উৎসবের সময় সকল শ্রেণীর নরনারী (বিশেষ করে গ্রামের জঘন্য চরিত্র লোকেরা) ওই সব স্থানে সম্মিলিত হয়। বন্ধ্যা নারীরা এখানে দেবতার কাছে এসে মানত করে যে তারা যদি সন্তানবতী হতে পারে তাহলে দেবতার প্রীতির জন্য কোন বিশেষ সংখ্যক পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে তবে বাড়ী ফিরে যাবে। এমন কি যেসব নারী বন্ধ্যা নয় তারাও দেবতার প্রতি তাদের ভক্তি প্রদর্শনের জন্য অতি নির্লজ্জভাবে অপরের সহিত যৌন-মিলনে প্রবৃত্ত হতো।
ধর্মের নামে আর এক রকমের গণিকাবৃত্তিও মন্দির সমূহে প্রচলিত ছিল। এ হচ্ছে দেবদাসী প্রথা । সেকালে দেবতার প্রীতির জন্য অনেকে নিজের মেয়েদের উৎসর্গ করতে দেবতার কাছে । এরা মন্দিরে থাকতো এবং এদের দেবদাসী বলা হতো। এদের উত্তমরূপে নাচ-গান শেখান হতো এবং তারা দেবতার সামনে নৃত্যগীত করতো । দেবদাসী যে হিন্দু-মন্দিরেই থাকতো তা নয়, বৌদ্ধমন্দিরেও থাকতো । কালক্রমে দেবদাসী প্রথা কদৰ্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল। এখনও অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা জীবিত আছে।
দেবদাসী প্রথা কত প্রাচীন তা জানা নেই। তবে মধ্যযুগের বাংলাদেশের বড় বড় মন্দিরে যে অনেক দেবদাসী থাকতো তার প্রমাণ আমরা ভবদেব ভট্টের “ভুবনেশ্বরী প্রশস্তি” এবং বিজয় সেনের “দেওপাড়া প্রশস্তি”তে পাই। সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত” ও ধোয়ীর “পবনদূত” কাব্যদ্বয়েও দেবদাসীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। অনেক সময় দেবদাসীর রাজানুগ্রহ লাভ করে রাজার গৃহিণীও হতেন। “রাজতরঙ্গিনী” থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন নগরে অবস্থিত কার্তিকেয়ের মন্দিরে কমলা নামী এক অলৌকিক রূপগুণসম্পন্ন দেবদাসী ছিল। কাশ্মীররাজ জয়াপীড় বিনয়াদিত্য তার প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিবাহ করেছিলেন। ওড়িষ্যার সোমবংশীয় নরপতি কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকেও আমরা জানতে পারি যে তার মহিষী কর্পূরশ্ৰী বিবাহের পূর্বে সলোনপুরের বিহারস্থিত বৌদ্ধমন্দিরে দেবদাসী ছিলেন। আরও জানা যায় যে কর্পূরশ্রীর মা-ও দেবদাসী ছিলেন।
বিবাহ-বহির্ভূত যৌন-মিলনের যে সকল দৃষ্টান্ত উপরে উল্লিখিত হলো সেগুলোর পিছনে সামাজিক বা ধর্মীয় অনুমোদন ছিল। এরূপ অনুমোদনের যেখানে অভাব ঘটতে সেখানে অবৈধ যৌনসংসর্গকে ব্যভিচার বলা হতো। হিন্দু ও আদিবাসী এই উভয় সমাজেই ব্যভিচার বরদাস্ত করে না। হিন্দুর স্মৃতিশাস্ত্রে ব্যভিচারের তারতম্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সকল রকম ব্যভিচারের মধ্যে গুরুতল্লই ( গুরু-স্ত্রীর সহিত যৌনসংসর্গ ) হচ্ছে সর্বাপেক্ষা জঘন্য। এরজন্য কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা ছিল । মনু বলেছেন, গুরুতর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ অপরাধীর চক্ষু উৎপাটন ও যৌনাঙ্গকর্তন করা হবে ও তাকে জলন্ত লৌহপট্টের উপব উপবেশন করানো হবে।
অন্যান্য রকম ব্যভিচার সম্পর্কে মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, প্রায়শ্চিত্ত করে ও অর্থদণ্ড দিয়ে তার স্খলন করা যায়। তবে কেহ যদি অবাঞ্ছিত নারীর সঙ্গে ব্যভিচার অপরাধে লিপ্ত হয় তা হলে তাকে কঠোর শাস্তিভোগ করতে হবে। এই সকল বিশেষ শ্রেণীর নারীর অন্যতম ছিল প্রতিপালিতা, বন্ধুপত্নী, সগোত্রা, পরিব্রাজিক ও কুমারী। নারদের মতে তপস্যারতা স্ত্রীলোকের সঙ্গে ব্যভিচার অজাচারের সামিল। সকলক্ষেত্রে গুরুতল্পের মত কঠোর দণ্ড দেওয়া হতো। কিন্তু উত্তরকালে দণ্ডের অনেক লঘুকরণ করা হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে এই সকল অপরাধের শাস্তিস্বরূপ কৌটিল্য মাত্র ২৪ পণ অর্থদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন।
আর একরকম ব্যভিচারের জন্যও স্মৃতিশাস্ত্রে কঠোর শাস্তির নির্দেশ আছে। সেটা হচ্ছে উচ্চবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে হীনবর্ণের পুরুষের ব্যভিচার। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই প্রকাশ্বস্থানে কুকুরদ্বারা খণ্ড-বিখণ্ডিত করাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিম্নবর্ণের স্ত্রীলোকের সঙ্গে উচ্চবর্ণের পুরুষেরও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে কঠোর দণ্ডেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সাধারণত তাকে রাষ্ট্র থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হতো। অস্ত্যজ স্ত্রীলোকের সঙ্গে ব্যভিচারের জন্য শূলে চাপিয়ে বধ করাই সাধারণ দণ্ড ছিল। ক্ষত্রিয়, বৈশু ও শূদ্র নারী যদি ব্রাহ্মণের সঙ্গে ব্যভিচার করতে তা হলে তাকে দগ্ধ করে মারা হতো। ওই একই শাস্তি দেওয়া হতে। পুরুষকে, যদি সে ক্ষত্রিয়া বা বৈশু নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে বা বৈশ্য পুরুষ যদি ক্ষত্রিয়া নারীর সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করতো।
তবে স্মৃতিশাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনাদণ্ডে কোন কোন বিশেষ শ্রেণীর নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা যেতো। এদের মধ্যে ছিল গণিকা ও ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্ত বর্ণের স্বৈরিণী। এ সব ক্ষেত্রে একে ব্যভিচার বলা হতে না। তবে পরগ্রহ বা অপরের রক্ষিতা নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম ব্যভিচার বলেই গণ্য হতো। আবার অপর পক্ষে নারদ বলেছেন যে স্বামী পরিত্যক্ত নিষ্কলঙ্ক স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌনমিলন ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না। স্বামী যদি নপুংসক হন, কী ক্ষয়রোগাক্রান্ত হন, সেক্ষেত্রেও অপর পুরুষের সহিত যৌনসঙ্গম ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না।