যৌন আতিথেয়তা প্রাচীন ভারতেও প্রচলিত ছিল। মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে। বিশেষ করে অনুশাসন পর্বে সুদর্শন ও ও ঘাবতীর কাহিনী এ সম্বন্ধে বিশেষ আলোকপাত করে। সুদর্শন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি গৃহস্থাশ্রম পালন করেই মৃত্যুকে জয় করবেন সঙ্কল্প করেছিলেন। স্ত্রী ওঘাবতীকে অতিথি সৎকারের কাজে নিয়োজিত করে তিনি তাকে আদেশ দেন যে, প্রয়োজন হলে ওঘাবতী যেন নির্বিচারে নিজেকেও অতিথির কাছে সমর্পণ করে। কেননা, অতিথি অপেক্ষ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আর কেউ নেই। একদিন তার আদেশের সততা পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর অনুপস্থিতকালে যমরাজ স্বয়ং ব্রাহ্মণের বেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ওঘাবতীর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। ওঘাবতী প্রথমে কৌশল করে এটা এড়াবার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্ৰাহ্মণবেশী ধর্মকে নাছোড়বান্দা দেখে অগত্যা তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হন। এই সময় সুদর্শন ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীকে সামনে দেখতে না পেয়ে তাকে বারবার ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না। কেননা ওঘাবতী তখন ব্রাহ্মণের সঙ্গে যৌনমিলনে নিযুক্ত থাকায় নিজেকে অশুচি জ্ঞান করে স্বামীর আহবানে সাড়া দেন না । এমন সময় অতিথি ব্রাহ্মণ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সুদর্শনকে বলেন যে ওঘাবতী তার কামনা পূর্ণ করেছে। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতা দেখে সুদর্শন অত্যন্ত প্রীত হন। ধর্ম তখন আত্মপ্রকাশ করে বলেন, “সুদর্শন, তুমি তোমার সততার জন্য এখন থেকে মৃত্যুকে জয় করলে।”
মহাভারতের আদিপর্বে উদালক পুত্র শ্বেতকেতুর কাহিনী থেকেও আমরা এর আভাস পাই। একদিন শ্বেতকেতু যখন পিতামাতার কাছে বসেছিলেন সেইসময় এক ব্রাহ্মণ এসে তার মায়ের সঙ্গে যৌনমিলন কামনা করে তাকে কক্ষান্তরে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এতে ক্রুদ্ধ হয় কিন্তু পিতা উদ্দালক বলেন, “স্ত্রীলোক-গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না—ইহাই সনাতন ধর্ম।“ মহাভারতে আরও উল্লিখিত আছে যে সন্তসুজাত অর্জুনকে বলেছিলেন যে বন্ধুত্বের ষড়গুণের মধ্যে অন্ততম হচ্ছে বন্ধুর নিকট নিজ পুত্র ও স্ত্রীকে সমর্পণ করা। কৃষ্ণও বন্ধুর কাছে পুত্র এবং স্ত্রীকে সমর্পণ করতে ইচ্ছা -শ্রকাশ করেছিলেন। কর্ণও বলেছিলে যে যদি কউ তাকে দেখিয়ে দেয় যে অর্জুন কোথায় আছে তাহলে তিনি তাকে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে সমপণ করবেন। মহাভারতের পরবর্তীকালে অবশ্য এ প্রথা ভারতে বিলুপ্ত হয়েছিল।
স্ত্রী বা কন্যাকে অপরের হাতে সমপণ করা সম্পর্কে মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে এক বিচিত্র প্রথা প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে কোন চুক্তির শর্ত হিসাবে বা ঋণের জামিনস্বরূপ উত্তমর্ণের কাছে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা অপর কোন আত্মীয়াকে বন্ধক রাখা হয়। ঋণ পরিশোধ বা চুক্তির শর্ত প্রতিপালন না হওয়া পর্যন্ত ওই স্ত্রী বা কন্যা পাওনাদারের গৃহেই থাকে।
বন্ধকী অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করবার যেমন উত্তমর্ণের অধিকার থাকে এক্ষেত্রে ওই স্ত্রী বা কন্যাকে ভোগ করবার সম্পূর্ণ অধিকারও পাওনাদারের থাকে। এই অবস্থায় পাওনাদারের গৃহে যদি ওই স্ত্রী বা কন্যা সন্তানবতী হয় তাহলে সে নিজ গৃহে পুনরায় ফিরে আসবার সময় ওই সন্তানকে পাওনাদারের গৃহে রেখে আসে। সাথিয়ারা এরূপভাবে স্ত্রী বা কন্যাকে বন্ধক রাখা মোটেই লজ্জাজনক বা নীতিবিগর্হিত ব্যাপার বলে মনে করে না।
ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ পরস্ত্রীর সহিত যৌনমিলন তন্ত্রশাস্ত্রে অনুমোদিত আছে। তান্ত্ৰিকসাধনার মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। এই প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনকে তন্ত্রশাস্ত্রে গৃহ রূপ দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে পঞ্চ “ম”-কার সহকারে চক্র-পূজার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চ “ম”-কার হচ্ছে মন্ত, মাংস, মৎস্য, মুদ্র ও মৈথুন। তন্ত্রপূজার এগুলি অত্যাবশ্বকীয় অঙ্গ। তন্ত্রে শক্তিসাধনা বা কুলপূজার উপর বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে শক্তির প্রতীক ধরে নিয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলনে রত থাকাই শক্তিসাধনার মূলতত্ত্ব। গুপ্তসংহিতায় বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি পামর, যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন-ক্রিয়ায় নিজেকে না নিযুক্ত রাখে ; নিরুক্ততন্ত্র এবং অন্যান্য অনেক তন্ত্রে বলা হয়েছে যে শক্তিসাধক কুলপূজা হতে কোনরূপ পুণ্যফল পায় না, যদি না সে কোন বিবাহিত নারীর সহিত যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হয়। এ কথাও বলা হয়েছে যে কুলপূজার জন্য কোন নারী যদি সাময়িক ভাবে স্বামীকে পরিহার করে তবে তার কোন পাপ হয় না। আরও বলা হয়েছে যে কূলপূজার জন্য প্রশস্তা নারী হচ্ছে ষোড়শী, সুদর্শনা এবং বিপরীত-রমণে সিদ্ধা। তবে অনূঢ়া কিংবা গণিকাকেও কুলপূজার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনেক সময় ধর্মের রূপ দিয়ে কামাচারী ব্রাহ্মণ প্ররোহিতরা বিবাহিতা নারীকে প্রলুব্ধ করতো তার সতীত্ব বিসর্জন দিতে। এরূপ ভাবে প্রলুব্ধ হয়ে সতীত্ব বিসর্জন দেবার এক কাহিনী অষ্টাদশ শতাব্দীর পর্যটক আবে দুবোয়া তার গ্রন্থে বিরত করে গেছেন। তিনি বলেছেন যে দক্ষিণ ভারতে এমন কতকগুলি মন্দির আছে যেখানকার পুরোহিতরা প্রচার করে যে আরাধ্য দেবতার অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে স্ত্রীলোকের বন্ধ্যতা দূর করবার। এরূপ মন্দিরের মধ্যে কর্ণাটদেশের তিরুপতির মন্দির বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এখানকার দেবতা ভেনকাটেশ্বরের কাছে অসংখ্য স্ত্রীলোক আসে সন্তান কামনায় । পুরোহিতগণ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তারা মন্দিরে রাত্রিযাপন করে। পুরোহিতরা তাদের বলে যে তাদের ভক্তি দ্বারা প্রীত হয়ে ভেনকাটেশ্বর রাত্রিকালে তাদের কাছে আসবে এবং তাদের গর্ভবতী করে দিয়ে যাবে। তারপর যা ঘটতো তা না বলাই ভাল। পাঠক তা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। পরদিন প্রভাতে এই সকল জঘন্য চরিত্রের ভণ্ড তপস্বীরা কিছুই জানে না এরূপ ভান করে ওই সকল স্ত্রীলোকদের কাছে এসে করুণা লাভ সম্বন্ধে বিশদভাবে অনুসন্ধান করত এবং তারা দেবতার অনুগ্রহ লাভ করেছে বলে তাদের পুণ্যবতী আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে দান গ্রহণ করত। দেবতার সঙ্গে তাদের যৌনমিলন ঘটেছে এই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এই সকল হতভাগিনী নারীরা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যেত।