কোলেদের মধ্যে আর এক রকম বিবাহেরও প্রচলন আছে । একে বলা হয় “ভাগল” বা কনেকে গোপনে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করা । এ ক্ষেত্রে তারা প্রথমে কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ী গিয়ে উপস্থিত হয় । বর সেখানে কনের হাতে দশগাছ কালো রং-এর চুড়ি পরিয়ে দেয় ও তার সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেয়। তারপর থেকে তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক অর্সায়। অনেক সময় এর সামাজিক স্বীকৃতির জন্য পঞ্চায়েতকে ভোজ দেওয়া হয়।
০৮. বিবাহ-পূর্ব যৌন সংসর্গ
হিন্দুদের মধ্যে বিবাহের পূর্বে যৌন সংসর্গ কখনও বরদাস্ত করা হয়না। আগেকার দিনে এরূপ ঘটনা ঘটলে বাপ-মায়ের জাত যেতে এবং সে মেয়ের কখনও বিয়ে হতে না । এটাই ছিল হিন্দুসমাজের প্রতিষ্ঠিত রীতি। আজকালকার দুর্নীতির দিনে বাপ-মাকে আর এরূপ দণ্ডভোগ করতে হয় না এবং মেয়েকেও অবিবাহিতা থাকতে হয় না।
আদিবাসীসমাজের কথা অবশ্য ভিন্ন। আদিবাসীসমাজের অনেকস্থলে বিবাহের পূর্বে ছেলেমেয়েদের পরস্পরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করবার সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া হয়। এর জন্য অনেক উপজাতির মধ্যে ছেলেমেয়েদের রাত্রিযাপনের জন্য “ঘুমঘর” আছে । ঘুমঘরগুলি সাধারণত দুরকমের হয়। ছেলে ও মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র ঘুমঘর ও ছেলেমেয়েদের একত্রে রাত্রিযাপনের যৌথ ঘুমঘর। স্বতন্ত্র ঘুমঘরগুলি নানাবিধ দক্ষতালাভের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। আর যৌথ ঘুমঘরগুলি তরুণীদের যৌনচর্চার দক্ষতা অর্জনের সংস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রদেশের গোগুদের মধ্যে প্রচলিত ঘুমঘরগুলিকে “ঘোটুল” বলা হয়। মুণ্ড ও বিরহোররা এগুলিকে “গিতিওড়া” বলে। আসামের গাড়োরা এগুলিকে “লোকপাণ্ডে” বলে । নাগাদের মধ্যে এগুলিকে বলা হয় “মোরাং” । যৌথ ঘুমঘরগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মুরিয়াদের মধ্যে প্রচলিত ঘোটুল। ঘুমঘর পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারের সাওতালদের মধ্যে, বিহারের ওরাওদের মধ্যে, ওড়িষ্যার খরিয়া, জুয়াঙ, খণ্ড ও ভুঁইয়াদের মধ্যে এবং ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বন, মায়ান ও পালিয়ানদের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। অনেক জায়গায় এগুলি মাত্র বিলীয়মান প্রথার চিহ্নমাত্র বহন করছে।
মুরিয়াদের মধ্যে বিদ্যমান ঘোটুল পূর্ণবিকশিত ঘুমঘরের প্রতীক । এদের মধ্যে ঘোটুল সাধারণত নির্মিত হয় গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, কাঠের খুটির দ্বারা পরিবেষ্টিত এক প্রাঙ্গণের মধ্যে। ঘোটুলের মধ্যে দাওয়া বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় গৃহ থাকে এবং ইহার সংলগ্ন ছোট ছোট অনেকগুলি ঘর থাকে। ঘোটুলের ভেতরটায় নানারকম চিত্র অঙ্কিত ও খোদিত থাকে। অনেকস্থলেই এ সকল চিত্র যৌন অর্থব্যঞ্জক। মাঝখানের কাঠের খুটিটির গায়ে একটি বৃহদাকার স্ত্রীযোনি খোদিত থাকে। আবার কোন কোন জায়গায় প্রকাণ্ডাকার পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট এক তরুণ এক তরুণীকে আলিঙ্গন করে ধরে আছে এইরূপ চিত্র অঙ্কিত থাকে।
ঘোটুলের ছেলেদের বলা হয় “চেলিক” আর মেয়েদের বলা হয় “মতিয়ারি”। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সমস্ত ছেলেমেয়ে ঘোটুলে এসে সমবেত হয়। ঘোটুলে প্রথম প্রবেশ ( বা দীক্ষা ) উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান পালিত হয় না। তবে ঘোটুলের সদস্যভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক । সকুল ছেলেমেয়েকেই ঘোটুলে প্রবেশ করতে হয়। কোন কারণেই কাহাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয় না। ঘোটুলের নিয়মানুবর্তিত হচ্ছে খুব কঠোর। এই কারণে ঘোটুলের নিয়ম-কানুন কেউ অগ্রাহ করতে সাহস করে না। ঘোটুলের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ একজনকে দলপতি নির্বাচিত করা হয় । তাকে বলা হয় “শিলাদার” বা “চালাও”। সেই ঘোটুলের ছেলেমেয়েদের মাতববর হিসাবে কাজ করে। চেলিক ও মতিয়ারিদের সেই পরিচালনা করে।
ঘোটুলের মধ্যে রকমের নিয়মানুবর্তিত দেখা যায়। প্রথম রকমের নিয়মানুবর্তিত অনুযায়ী কোন বিশেষ ছেলে কোন বিশেষ মেয়ের সঙ্গে “জুরিদার” সম্পর্ক স্থাপন করে। তারা বিবাহিতের ভণিতা নিয়ে বাস করে, তবে যে কোন সময় তারা এ সম্পর্ক চ্যুত করতে পারে। তবে যতদিন তারা “বিবাহিত” থাকে ততদিন তাদের পক্ষে ব্যভিচার দণ্ডনীয় হয়। দ্বিতীয় রকমের নিয়মানুবর্তিত অনুযায়ী যে কোন ছেলে যে কোন মেয়ের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তবে পরপর তিনদিনের বেশী যদি কেউ কোন মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শয়ন করে তবে তার জন্য তাকে দণ্ড পেতে হয়। যেখানে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে “জুরিদার” সম্পর্ক স্থাপিত হয় সেখানে প্রায়ই দেখা য়ায় যে তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থায়ী হয়। তবে প্রকৃত .বিবাহের বয়স হলে তাদের নিয়মানুগ বিবাহ করতে হয়।
ঘোটুলের দ্বিতীয় রকমের সম্পর্ককে “মুণ্ডি বদলানা” বলা হয়। এ সম্পর্ক কখনও স্থায়ী হয় না, কেননা কোন ছেলে পরপর তিনদিনের বেশী কোন মেয়েকে নিজের অধিকারে রাখতে পারে না। যদি রাখে তা হলে সেটা ব্যভিচার বলে গণ্য হয়। ভবিষ্যতে অপরের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তুতি হিসাবে স্থায়ী সম্পর্ক ভাল নয় বলে মনে করা হয়। তারা বলে যে “বিবাহের আগে অধিক প্রেম মানে বিবাহের পর স্বল্প প্রেম”। এছাড়া মুরিয়ার আরও বিশ্বাস করে যে অনবরত জুরিদার পরিবর্তন করলে যৌনসংসর্গে সন্তানবতী হবার সম্ভাবনা কম থাকে। কার্যক্ষেত্রে শিলাদার বা চালাও প্রত্যেক ছেলের জন্য মেয়ে নির্বাচন করে দেয়। ঘোটুলের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, কী সুন্দরী, কী কুৎসিত সকল মেয়েই সমান অধিকার পায় যৌন চর্চার জন্য। ছেলেদের পক্ষেও ঠিক তাই প্রযোজ্য।