মহবুবনগরের চেংচুদের মধ্যে বরের দল কিছু মহুয়া ফুল, মদ ও একজন ঢুলিকে নিয়ে কুনের বাড়ীর দিকে যাত্রা করে। কনের বাড়ীর কাছাকাছি এলে ঢাকী ঢাক বাজাতে আরম্ভ করে। তারপর কন্যাপক্ষের লোকের বরের দলকে অভ্যর্থনা করতে থাকে। অভ্যর্থনা করে তাদের নিয়ে যাবার পর নাচ, গান, ভোজ ও মদ্যপান চলে। পরের দিন সকালে সকলে একত্রিত হয়ে আবার ভোজ ও মদ্যপান করে। বর তারপর কনেকে একখানা শাড়ী, একখানা চেলি ও একটা পুতির মালা দেয়। কনে পুতির মালাটি নিজের গলায় পরে। এর পর সমাগত অতিথিরা ও কনের বাবা বরকে বলে, সে যেন স্ত্রীকে মুখে রাখে ও তার প্রতি যত্নবান হয়। এখানেই বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
বিবাহ উপলক্ষে উদয়পুরের নাগাসিয়াদের মধ্যে এক বিচিত্র অনুষ্ঠান আছে। বর আনুষ্ঠানিকভাবে নদীতে স্নান করবার পর তীরধমুক নিয়ে এক কল্পিত মৃগের দিকে সাতবার ধাবমান হয়। সাতবারের পর তার ভগ্নীপতি এসে তীরটা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। বর তাকে ধরবার জন্য পিছনে পিছনে ছুটে । যদি তাকে ধরতে না পারে তা হলে এক আনা অর্থদণ্ড দিতে হয়। এখানেই বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তবে আনুষ্ঠানিক স্নানের পূর্বে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় সেগুলো উপজাতি ও হিন্দুসমাজের আচার-অনুষ্ঠানের মিশ্রণে রচিত।
যশপুরের রাউতিয়াদের মধ্যে বিবাহ উপলক্ষে “দুলহা দেও”-এর পূজা করা হয়। কনেকে একটা ডুলি করে নিয়ে আসা হয়। কালে রং-এর ছোপবিশিষ্ট লাল রং-এর একটা ছাগল আনা হয় এবং এক জায়গায় রাশিক্ত চাউল রেখে তাকে খেতে দেওয়া হয়। তারপর সেই ছাগলটিকে বাড়ীর বাইরে এক কোণে কাটা হয়। ছাগলের রক্ত বাড়ীর ভিতরে এনে চাউলের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় ও তিনবার “ফুলহা দেও”-এর কাছে প্রার্থনা দ্বারা নবদম্পতির সুখ, শাস্তি ও মঙ্গল কামনা করা হয়। তারপর রক্ত ছিটানো চাউলগুলি নদীতে ফেলে দেওয়া হয় এবং ছাগ-মাংস রান্না করে পরিবারের সকলে ও অতিথিরা খায়। এদের মধ্যে অন্তান্ত আচার-অনুষ্ঠানগুলি প্রতিবেশী অন্য উপজাতিদের মতই, কেবল দ্বিতীয় দিনে বরকে একটি আমগাছের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ধূপ-ধুনা জালিয়ে বরকে ওই আগুনের উপর আটা, ঘি, গুড় ইত্যাদি ছিটিয়ে দিতে বলা হয়। পরে গাছটির চারদিকে স্থত জড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ওর একটা ডাল এনে কনের বাড়ীর বিবাহমণ্ডপে পুতে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বিবাহের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান নাপিত কর্তৃক অনুষ্ঠিত হয়। বর-কনের মুখে ও গলায় সিন্দুর মাখিয়ে দেওয়া হয় এবং উপস্থিত সকলের মধ্যে অন্ন বিতরণ করা হয়। তারপর একটা আমডালের সাহায্যে বর-কনের উপর শাস্তিজল ছিটিয়ে দেওয়া হয় ও তাদের উভয়ের কাপড় নিয়ে গাটছড়া বেঁধে দেওয়া হয়। রাউতিয়ারা বলে যে তাদের মধ্যে এ সকল আচার-অনুষ্ঠান আদিমকাল থেকে অনুস্থিত হয়ে এসেছে ।
মধ্যভারতের কোলজাতির মধ্যে বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানসমূহ উপজাতি ও হিন্দু—এই উভয় সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছে। এদের মধ্যে বাগ দান ও বিবাহের লগ্ন স্থির হয়ে যাবার পর, বর-কনে উভয়ের বাড়ীতে “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠান সম্পাদন করা হয়। বিবাহ উপলক্ষে যে সমস্ত চুলা (উনুন ) তৈরী করা হয় তার জন্য মাটি সংগ্রহ করাই “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। “মঙ্গর মাটি” অনুষ্ঠান বর ও কনের বাটিতে একই রাত্রে সম্পাদিত হয়। মাত্র মেয়েরাই এই পবিত্র মাটি সংগ্রহ করে। পাঁচ-সাতটি চুলা তৈরী করা যেতে পারে এরূপ পরিমাণ মাটি সংগ্রহ করা হয় এবং সেই রাত্রেই চুলাগুলো তৈরী করা হয়। পরের দিন চুলা সমূহে “লাওয়া” তৈরী করা হয়। লাওয়া হচ্ছে খই ও জোয়ার-এর মিশ্রণে প্রস্তুত একটা পদার্থ যা কোলজাতির মধ্যে বিবাহের এক অত্যাবশ্বকীয় উপকরণ। লাওয়া তৈরী করবার পর তা একটা নতুন হাড়িতে রাখা হয়। এই হাড়ির গায়ে মেয়েছেলের চিত্র অঙ্কিত থাকে। অনেকসময় ওই হাড়ির মধ্যে আতপ চাউল, হলুদ এবং দুটি পয়সা রাখা হয়। বরের বাড়ী যে লাওয়া তৈরী করা হয়, তা বরযাত্রীর সঙ্গে করে কনের বাড়ী নিয়ে আসে এবং সেখানে কনের বাড়ীতে তৈরী লাওয়ার সঙ্গে মিশ্রিত করা হয় ।
বিবাহ উপলক্ষে কনের বাড়ীর উঠানে একটা মণ্ডপ তৈরী করা হয়। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন অনুযায়ী এবং বিশেষ গাছের কাঠ দিয়ে এই মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়। মণ্ডপটিকে “মাড়ওয়া” বলা হয়। এই মাড়ওয়ার মধ্যেই বিবাহ সম্পাদিত হয়। এদের মধ্যে বিবাহ তিন ংশে তিন দিনে নিম্পন্ন হয়। প্রথম দিনের সন্ধ্যায় বরাত বা বরযাত্রীর দল কনের গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। কনের বাড়ীর সমস্ত মেয়েরা মশাল হাতে করে গ্রামের সীমান্তে গিয়ে বরযাত্রীদের স্বাগত জানায় । যারা স্বাগত জানাতে যায় তাদের নেত্রী হয়ে যায় কনের সহোদরা বা অন্ত কোন বোন। বিবাহ হয় তার পরের দিন রাত্রে। বিবাহ সম্পাদিত হয় ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা। কিন্তু আগে থেকে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে পুরোহিতের সাহায্য নেওয়া হবে না, তা হলে বিবাহ সম্পাদন করে কনের পিসে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে বিবাহ মণ্ডপের মধ্যে নিম্পন্ন হয়। বর কনের সিথিতে সিন্দূর পরিয়ে দেয় । তারপর কনের বোন বর-কনের কাপড়ের কোণ নিয়ে গাটছড়া বেঁধে দেয়। এরপর বর-কনে পবিত্র দণ্ডের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে। কনের বয়স যদি খুব কম হয় তা হলে মাত্ৰ পাচবার প্রদক্ষিণ করা হয় আর কনে যদি “সেয়ানা” হয় তা হলে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। প্রদক্ষিণের পর বর কনেকে অনুসরণ করে ও ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। সেখানে একটি প্রদীপ জ্বলে এবং কনের মা বরকে ফু দিয়ে সেই প্রদীপটি নিবিয়ে দিতে বলে। কিন্তু কনের মায়ের কাছ থেকে কিছু দক্ষিণ না পাওয়া পর্যন্ত বর এক কথায় এ কাজ করে না। তারপর তাদের গাটছড়া খুলে দেওয়া হয় এবং কনের শাড়ীর এক অংশ তার মুখের সামনে ধরে বরকে শুভদৃষ্টি করতে বলা হয়। পরের দিন “বিদা” বা বরের বাড়ী ফিরে যাওয়ার পালা পড়ে। কন্যাপক্ষ বরপক্ষের সঙ্গে গ্রামের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে তাদের বিদায় দেয়। কোলেদের মধ্যে কনে কিন্তু বরের সঙ্গে যায় না । সে বাপের বাড়ীতেই থেকে যায়। কনের যখন যৌবন প্রাপ্তি ঘটে বর তখন “গৌণা” অনুষ্ঠান সম্পাদন করে কনেকে নিজের বাড়ী নিয়ে যায়। যেক্ষেত্রে বিবাহের সময় মাত্ৰ পাচবার দণ্ড প্রদক্ষিণ করা হয়েছিল সেক্ষেত্রে বাকী দুবার এই সময় প্রদক্ষিণ করতে হয়। কোলেদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে “রওনা” অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। রওনা আর কিছুই নয়, বর কর্তৃক কনেকে নিজের বাড়ী নিয়ে যাওয়া মাত্র ।