বর এলে মেয়ের বাবা ও মা জল ও দুধ দিয়ে বরের পা ধুইয়ে দেয়। তারপর যেখানে বিয়ে হবে সেখানে বরকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে সামনা-সামনি দুখানা পিড়ি থাকে। বরকে একটা পিড়ির ওপর দাড় করিয়ে দেওয়া হয়। দুজন মহিলা একখানা কাপড়ের ফুকোণ ধরে বরের সামনেট আড়াল করে দেয়। একে “অন্তরপট” বলা হয়। তারপর কনের মামা কনেকে নিয়ে এসে তাকে অপর পিড়িতে দাড় করান। এরপর আটবার “মঙ্গলাষ্টক” মন্ত্র পাঠ করা হয়। “মঙ্গলাষ্টক” শেষ হলে বর-কনের মধ্যবর্তী কাপড়ট সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন কনে বরের গলায় মালা পরিয়ে দেয় আর বর সোনার পুতি দিয়ে তৈরী “মঙ্গলসূত্রম” কণ্ঠী কনের গলায় পরিয়ে দেয়। তারপর বর-কনে পাশাপাশি বসে ও মেয়ের বাবা কন্যাদান করে। মহারাষ্ট্রের কন্যাদান অনুষ্ঠানটা একটু বিচিত্র। বরের হাতের উপর কনের হাত রেখে কনের বাবা মেয়ের হাতে একটু জল ঢেলে দেন। মেয়ের আঙুলের ফাক দিয়ে জল বরের হাতে পড়লেই ‘কন্যাদান অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। এরপর লাজহোম, অগ্নি প্রদক্ষিণ, ঘৃতাহুতি ও সপ্তপদীগমন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর আসে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের খাওয়ান-দাওয়ানর ব্যাপার। এরপরই বর-কনে বিদায় নেয়।
বরের বাড়ীর সদর দরজায় এক কুনকে চাল রাখা হয়। কনে এসে প্রবেশ করবার সময় পা দিয়ে সেই চালের কুনকে ঘরের ভিতর ছুড়ে ফেলে দেয়। বর এই সময় কনের নূতন নামকরণ করে। মহারাষ্ট্র দেশে মেয়েদের বিয়ের পর বাপের বাড়ীর দেওয়া নাম পরিহার করতে হয়। বিয়ের পর স্বামী যে নূতন নাম দেন সেই নামেই সে পরিচিত হয়। সেই রাত্রেই বর-কন্যার ফুলশয্যা হয়।
গুজরাটে বরপক্ষ যখন প্রথম মেয়ে দেখতে আসে তখন সেই সঙ্গে ছেলে নিজেও আসে। বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মধ্যে কথাবার্তা শেষ হলে এবং মেয়ে পছন্দ হলে তখন সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাত্র ছেলে ও মেয়ে সেই ঘরে থাকে ও তারা নিজেদের মধ্যে ইচ্ছামত আলাপ করে। তারপর বরপক্ষকে নানারকম মিষ্টান্ন খাওয়ান হয়। একে “মিঠাজিভ” বলা হয়।
তারপর একদিন যে অনুষ্ঠান হয় তার নাম “সওয়া রূপিয়া লিয়া।” এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সকলেই শ্ৰীনাথজী ঠাকুরের নামে সওয়া রূপিয়া নিবেদন করে। পরে ওই টাকা শ্ৰীনাথজীর মন্দিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর হয় “চুনরি প্রসঙ্গ”। এই উপলক্ষে ছেলের মা একখানা সবুজ রঙের জরির নকশাদার শাড়ী, অলঙ্কার, মিষ্টান্ন,নারিকেল প্রভৃতি নিয়ে মেয়ের বাড়ী আসে ও তাকে কুস্কুমের তিলক পরিয়ে সেগুলি তার হাতে দেয়। এছাড়া মেয়ের নাকে একটা নাকছবি ও পায়ে রূপার আংটি পরিয়ে দেয়। এরপর “নারিকেল বদলী” অনুষ্ঠানের জন্য মেয়েপক্ষের মহিলারা ছেলের বাড়ী যায় ও বরকে কুস্কুমের তিলক পরিয়ে তাকে আশীৰ্বাদ করে। তারপর মেয়ের ভাবী ননদ বা জ এসে মেয়েকে ছেলের বাড়ী নিয়ে যায়। সেখানে মেয়ের পায়ে কুঙ্কুম লাগিয়ে একখানা শাদা কাপড়ের উপর দু’পায়ের ছাপ নেওয়া হয়। ছেলের মা তাকে একখানা নূতন শাড়ী দেন ও আদর করে তাকে সরবৎ খাওয়ান ।
গুজরাটে বিয়ে সাধারণত দুপুরবেলা হয়। সবুজ বা লাল রঙের শাড়ী পড়ে বিয়ে হয়।
বর বিয়ে করতে এলে মহিলারা বরের প্রশংসায় গান করে। বর এলে কনে বরের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। বরও কনের গলায় মালা পরায়। তারপর কনের মা বরকে আরতি করেন ও জলপূর্ণ কলসী নিয়ে বরণ করেন। তারপর পুরোহিত যজ্ঞাগ্নি জেলে মন্ত্রপাঠ করেন। মন্ত্রপাঠ শেষ হলে মেয়ের বোন বা ‘ভাবী মেয়েকে নিয়ে বিবাহমণ্ডপে আসে। একটুকরা হলুদ-কাপড় মেয়ের শাড়ীর আঁচলের সঙ্গে বেঁধে বরের কাধের উপর স্থাপন করা হয়। তারপর বর-কনে চারবার হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করে। একে “ফেরা” বলা হয়। তারপর বরকনেকে দেবতার মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর খাওয়ান দাওয়ান হয়। খাওয়ান-দাওয়ান শেষ হলে সেই রাত্রেই বর-কনে বিদায় নেয়। বর-কনে বাড়ী পৌছলে বরের মা তাদের আরতি করে ঘরে তোলেন। তারপর বর-কনেকে দিয়ে গণেশ পূজা করান হয়। সেই রাত্রেই ফুলশয্যা হয় ।
হরিয়ানাতেও বিবাহে হিন্দুর চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী মাল্যদান, হবন বা হোম, কাঠবন্ধন, কন্যাদান, অগ্নিপ্রদক্ষিণ, লাজবর্ষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে অগ্নিপ্রদক্ষিণ শেষ হলে বরের বোনের কনেকে মালা পরান ও মিষ্টিমুখ করান। এই অনুষ্ঠানকে “চৌকা” বলা হয়। এর জন্য মেয়ের মা বরের বোনেদের শাড়ী দেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি প্রথা হরিয়ানায় দৃষ্ট হয়। যেমন, বিবাহমণ্ডপে কলাগাছ বসান, রাত্রিকালে বিবাহ, বিয়ের পরের দিন বর-কনের বিদায় ইত্যাদি। কনে শ্বশুরবাড়ী পৌছলে শাশুড়ী সদর দরজায় এসে বর-কনেকে দুধভরা ঘটি দিয়ে আশীৰ্বাদ করেন। পশ্চিম বঙ্গের মত কনের কোলে একটি ছোট ছেলেকেও বসিয়ে দেওয়া হয়। সেই রাত্রেই “সোহাগ-রাত” বা ফুলশয্যা হয়।
আদিবাসীসমাজেও বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে বিবাহবিষয়ক আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে হিন্দুদের তুলনায় আদিবাসীসমাজের আচার-অনুষ্ঠান অনেক পরিমাণে সরল, সংক্ষিপ্ত ও আড়ম্বরহীন । বিবাহ সাধারণত একদিনেই সমাপ্ত হয়। তবে কোন উপজাতিসমাজে এর জন্য একাধিক দিনও লাগে। যেমন, মধ্যপ্রদেশের বারগুণ্ডাদের মধ্যে বিবাহ তিনদিনে সমাপ্ত হয় । আদিবাসীসমাজে বিবাহ সাধারণত কোন জ্যেষ্ঠ আত্মীয় বা আত্মীয়া বা পঞ্চায়েত বা বাইগা ( ওঝা ) দ্বারা সম্পাদিত হয়। তবে যে সকল উপজাতি হিন্দুভাবাপন্ন হয়েছে ( যেমন মধ্যপ্রদেশের পাতলিয়া ভালজাতি বা যশপুরের গোগুজাতি) তারা ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারাই বিবাহ সম্পাদন করায়। আবার উপজাতিদের মধ্যে কোন কোন জায়গায় বিবাহ অনুষ্ঠানকে ধর্মীয় স্বরূপ দেবার জন্য দেবদেবীরও পূজা করা হয়। আবার কোন কোন জায়গায় অনুষ্ঠানের কোন বালাই নেই ; মাত্র মালাবদল, কী তালিবন্ধন, কী কন্যার সিঁখিতে সিন্দুর ঘর্ষণ, কী কন্যাকে লুণ্ঠন করবার নাটকীয় অনুকরণ করেই বিবাহ করা হয়। এ সম্পর্কে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে আচারঅনুষ্ঠানের যে বৈচিত্র্য আছে তা নীচের দৃষ্টান্তগুলি থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাবে।