হিন্দুদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত হয় গোত্রপ্রবর দ্বারা। আর আদিবাসী সমাজে এগুলি চিহ্নিত হয় টটেম দ্বারা । টটেম বলতে গোষ্ঠীর রক্ষকস্বরূপ কোন শুভসাধক পরমাত্মাকে বোঝায়। এই পরমাত্মা কোন বৃক্ষ, প্রাণী বা জড়পদার্থের মধ্যে নিহিত থাকে। আদিবাসীদের বিশ্বাস যে, গোষ্ঠীসমূহের উৎপত্তি হয়েছে এই সকল বিশেষ প্রাণী, বৃক্ষ বা জড় পদার্থ থেকে। যে প্রাণী বা বৃক্ষ, যে গোষ্ঠীর টটেম, তাকে তারা বিশেষ শ্রদ্ধা করে। কখনও তাকে বিনাশ করে না। সেই প্রাণীর মাংস বা সেই বৃক্ষের ফল কখনও খায় না ।
একই টটেমের ছেলেমেয়েরা কখনও পরস্পরকে বিয়ে করতে পারে না। বিয়ে করতে হলে তাদের ভিন্ন টটেমে বিয়ে করতে হয়। কিন্তু আদিবাসী সমাজে সবজায়গাতেই যে বহির্বিবাহের বিধি টটেমের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা নয়। কোন কোন জায়গায় এগুলি আরাধনা পদ্ধতির উপর স্থাপিত। মধ্যপ্রদেশের গোগুজাতির কোন কোন শাখার মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলিকে “বংশ” বলা হয়। যে বংশ যত সংখ্যক দেবদেবীর পূজা করে, তার দ্বারাই সে বংশ চিহ্নিত হয়। দুই বংশের দেবদেবীর সংখ্যা যদি সমান হয়, তা হলে তাদের মধ্যে বিবাহ হয় না। মনে করুন, যে “বংশ” সাতটি দেবদেবীর পূজা করে, তাদের ছেলেমেয়েকে বিবাহ করতে হলে, সাত ভিন্ন অন্ত সংখ্যক দেবদেবীতে পূজারত “বংশে” বিয়ে করতে হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বহিবিবাহের গোষ্ঠীগুলি গ্রাম বা অঞ্চল ভিত্তিতেও চিহ্নিত হয়। যেমন— ছোটনাগপুরের মুণ্ডাজাতির মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত আছে যে, নিজের গ্রামে কেহ বিবাহ করতে পারবে না। ওড়িষ্যার খগুজাতির মধ্যেও অনুরূপ নিয়ম আছে। খণ্ডদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠী গুলিকে “গোচী” বলা হয়। গোষ্ঠীগুলি এক একটা “মুতা” বা গ্রামের নাম অনুযায়ী চিহ্নিত হয়। তাদের এই বিশ্বাস যে, একই গোষ্ঠীর সমস্ত স্ত্রী-পুরুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত—এই কারণে তাদের মধ্যে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, সুতরাং তাদের মধ্যে অন্তর্বিবাহ হতে পারে না। হলে সেটা অনাচার হবে । নাগাল্যাণ্ডের অনেক জাতির মধ্যেও এইরূপ গ্রামভিত্তিক বহির্বিবাহ গোষ্ঠী আছে। সেগুলিকে সেখানে “খেল” বলা হয়। বলা বাহুল্য কেহ নিজ খেলের মধ্যে বিবাহ করতে পারে না। বরোদার কোলিজাতির মধ্যেও নিজ গ্রামে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। এ সম্বন্ধে তাদের মধ্যে একটা গ্রাম-ক্রম দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে “ক” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয়, “খ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে আবার “খ” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় “গ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে, এইরূপ ক্রমে। বরোদার হিন্দুদের মধ্যেও কোন কোন জায়গায় গ্রাম অনুগামী বহির্বিবাহ প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে রাজপুত ও লেওয়া কুম্বীরা কখনও নিজ গ্রামে বিয়ে করে না। আবার দক্ষিণ ভারতের তামিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে এর বিপরীত প্রথা দেখা যায়। সেখানে কিছুকাল আগে পর্যন্ত নিজ গ্রাম ছাড়া অপর গ্রামে কেহ বিবাহ করতে পারতো না ।
আগেই বলা হয়েছে যে হিন্দুদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি চিহ্নিত হয় “গোত্রপ্রবর” দ্বারা। ব্রাহ্মণদের মধ্যে এগুলি আখ্যাত হয় কোন পূর্বপুরুষ ঋষির নামে। ব্রাহ্মণেতর জাতিদের মধ্যে কুলপুরোহিতের গোত্রই অবলম্বিত হয়।
উত্তর ভারতের হিন্দুসমাজে বিবাহ, গোত্রপ্রবর বিধি নিষেধের উপর প্রতিষ্ঠিত। সগোত্রে বিবাহ কখনও হয় না। তামিল নাড়ব ব্রাহ্মণরাও গোত্রপ্রবর বিধি অনুসরণ করে। কিন্তু পশ্চিম ভারতের মারাঠারা ও দক্ষিণ ভারতের হিন্দুসমাজভুক্ত কোন কোন জাতি গোত্রপ্রবর বিধি অনুসরণ করে না। তাদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলিকে “দল” বলা হয় এবং সেগুলি টটেম অনুকল্প কোন প্রাণী, বৃক্ষ বা জড়পদার্থ দ্বারা চিহ্নিত হয়।
হিন্দু সমাজে অবাধ বিবাহের অপর এক প্রতিবন্ধকতা আছে। সেটা হচ্ছে রক্তের একমূলত সম্পর্কিত দ্বিপাশ্বিক বিধি। একে সপিণ্ড বিধান বলা হয়। সপিণ্ড বিধি বিশেষভাবে প্রচলিত আছে উত্তর ভারতে। এই বিধান অনুযায়ী সপিণ্ডদের মধ্যে কখনও বিবাহ হয় না। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বিবাহ ব্যাপারে সর্বত্রই সপিণ্ড বর্জন করে। সপিণ্ড বলতে পিতৃকুলে উধ্বতন সাত-পুরুষ ও মাতৃকুলে উধ্বতন পাঁচ-পুরুষ বোঝায়। অঙ্ক কষে দেখা গেছে যে এই নিয়ম পালন করতে গেলে, অগণিত সম্ভাব্য জ্ঞাতির সঙ্গে বিবাহ পরিহার করতে হয়। এজন্ত বর্তমানে সপিণ্ড বিধিকে সংক্ষেপ করে তিনপুরুষে দাড় করান হয়েছে।
কিছুকাল আগে পর্যন্ত হিন্দুসমাজে গোত্রপ্রবর বিধি ছাড়া অবাধ বিবাহের আর এক বাধা ছিল। তাহা কৌলীন্য প্রথা । কৌলীন্য প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে ও মিথিলায় । আদিবাসী সমাজেও কোন কোন জায়গায় কৌলীন্য প্রথা দেখা যায়। কৌলীন্য প্রথায়, বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি মর্যাদার তারতম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রথানুযায়ী উচ্চতর গোষ্ঠীভুক্ত মেয়ের বিবাহ, কুলীন গোষ্ঠীতে দেওয়া চাই। হীনতর মর্যাদাবিশিষ্ট গোষ্ঠীতে দিতে পারা যায় না। দিলে তাকে পতিত হতে হতো। সেজন্য যে সমাজে কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত থাকে, সে সমাজে কন্যাব বিবাহের জন্য পাত্র পাওয়া অত্যন্ত তুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় বৃদ্ধবয়স পর্যন্ত কুলান কন্যার বিবাহ হতো না। এ কারণে কোন কোন স্থানে কৌলীন্য-কলুষিত সমাজে শিশুকন্যা হত্য প্রচলন ছিল। আবাব কোন কোন স্থলে, যেমন—বালাদেশে কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে পাইকারী হাবে বহুবিবাহ দ্বারা কৌলীস্তোব কঠোর বিধান এড়ান হতো। এরূপ শোন। ঘায় যে কোন কোন ক্ষেত্রে গঙ্গাযাত্রী কুলীন বুদ্ধেব সঙ্গে কুলীন কন্যাব বিবাহ দিয়ে কৌলীন্ত মর্যাদা রক্ষা করা হতো ।