আর একটি কথা এখানে বলা দরকার। পূর্ববঙ্গে কতকগুলি আচারঅনুষ্ঠান আছে, যা পশ্চিমবঙ্গে নেই। এগুলি মঙ্গলাচরণ, অধিবাস ( পশ্চিমবঙ্গের গাত্রহরিদ্রার পরিবর্ত ), নিদ্রাকলস, ও দধিমঙ্গল । এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান একই প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের তো কথাই নেই। তা তামিলনাড়র আচার-অনুষ্ঠান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাবে।
তামিলনাড়র ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠান পাচদিন ব্যাপী স্থায়ী হয়। তবে এর মধ্যে দুদিন হচ্ছে প্রধান । এ দুদিন হচ্ছে বিবাহের দিন ও তার পূর্বদিন। বিয়ের আগের দিন বরের দল (এর মধ্যে থাকে বরের পিতামাতা ও ভাই-বোনের ) আসে কনের গ্রামে। সেখানে স্বতন্ত্র বাড়ীতে তাদের থাকার, আদর আপ্যায়ন ও আহারাদির ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে তারা নিকটস্থ কোন মন্দিরে গিয়ে দেবতার অর্চনা করে। তারপর বরকে একটি সজ্জিত যানে করে বিবাহমণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। একে বলা হয় “যানবাসন” বা “মপিপলই আঝাইপপু” বা বরানুগমন। বিবাহ মণ্ডপে সমবেত লোকের সামনে ঘোষণা করা হয় যে পরদিন ওই বরের সঙ্গে অমুকের মেয়ের বিয়ে হবে। একে বলা হয় “নিচয় থারথম” এবং এই অনুষ্ঠানের সময় বর-কনেকে এক সঙ্গে বসান হয়। এরপর ভোজ উৎসব হয়।
বাংলাদেশে বিবাহ হয় রাত্রে আর তামিলনাড়তে বিবাহ হয় দিনের বেলায় মধ্যান্ত্রের পূর্বে। বিবাহের দিন প্রাতের প্রথম অনুষ্ঠান হচ্ছে “ব্রতম”। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবদম্পতির সুখশান্তি ও দীর্ঘায়ু কামনা করা এবং সমস্ত বাধাবিপত্তি ও অমঙ্গল প্রতিহত করা । এই সময় কতগুলি কপটভাবের ভান করা হয়। বর কয়েকজন ব্রাহ্মণকে পাঠিয়ে দেয়, তার জন্য একটি যোগ্য পাত্রীর অন্বেষণে আর নিজে একটি পুটুলীর মধ্যে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়-চোপড়, একটি ছাতা ও লাঠি নিয়ে “কাশীযাত্ৰা” করে। এই কপটভাবের দ্বারা সে দেখাতে চায় যে উপযুক্ত কনে না পাওয়ার দরুন সে দেশত্যাগী হয়ে কাশী যাচ্ছে। এই সময় পথে মেয়ের বাপ তার গতিরোধ করে তাকে বলে যে তার একটি উপযুক্ত মেয়ে আছে, মেয়েটিকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবে।
তারপর বর-কনেকে একটি ঝোলায় বসান হয় এবং মেয়ের স্ত্রী-আচার ঘটিত অনুষ্ঠানসমূহ সম্পাদন করে।
এর পর মূল অনুষ্ঠানসমূহ আরম্ভ হয়। দক্ষিণ ভারতের সর্বত্রই বিবাহ অনুষ্ঠানের মূল অংশ হচ্ছে “তালিবন্ধন” । তালির অপর নাম হচ্ছে “থিরুমঙ্গলম”। বিবাহের শুভ মুহুর্তে বর কর্তৃক কনের গলায় থিরুমঙ্গলম বেঁধে দেওয়া হয়। এটা আমাদের বাংলাদেশের “সিন্দুর দানের” পরিবর্ত মাত্র। থিরুমঙ্গলম জিনিসটা কি তা এখানে একটু বিশদভাবে বলা দরকার। থিরুমঙ্গলম হচ্ছে সোনার তৈরী লকেটের মত একটা জিনিস যার উপর শিবলিঙ্গ বা কোন ফুল খোদিত থাকে। বিশেষ আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের সঙ্গে এই জিনিসটা স্বর্ণকারকে তৈরী করতে দেওয়া হয়। একখানা আলপনা দেওয়া পিড়ির উপর স্বর্ণকারকে পূর্বদিকে মুখ করিয়ে বসান হয় এবং তাকে থিরুমঙ্গলম তৈরী করবার জন্য সোনা ও একটি থালায় করে পান, স্বপারী, আতপ চাউল ও কিছু দক্ষিণ সমেত একটি “সিধে” দেওয়া হয়।
দক্ষিণ ভারতে সধবা স্ত্রীলোককে “সুমঙ্গলী” বলা হয়। আমাদের বাংলাদেশে সিথির সিন্দুর ও হাতের “নোয়া” যেমন সধবা স্ত্রীলোকের চিত্ন, দক্ষিণ ভারতে তেমনি থিরুমঙ্গলম “সুমঙ্গলী” স্ত্রীলোকের চিহ্ল।
দক্ষিণ ভারতে বিবাহের শুভলগ্নের সময় বর ও কনেকে পিড়ির উপর বসান হয়। তারপর পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে হোম দেয়। এই সময় বর একখানা মূল্যবান শাড়ী সমেত থিরুমঙ্গলমটি কনের হাতে দেয়। বরকেও ওই সময় একখানা মূল্যবান বস্ত্র দেওয়া হয়। ওই বস্ত্রকে “অঙ্গবস্ত্র” বলা হয়। বর-কনে এই সময় ওই বস্ত্র ও শাড়ী পরে। থিকমঙ্গলমটিকে হলুদসিক্ত স্থতোয় বেধে দেবতাদের কাছে উৎসর্গের জন্য দেওয়া হয়। উৎসর্গীকৃত হবার পর থিরুমঙ্গলমটিকে একটি থালার উপর রেখে সমবেত লোকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের আশীৰ্বাদ গ্রহণের জন্য। তারপর একটা “জোয়াল” পূজা করা হয় ও সেটা বর-কনের কাধের উপর স্থাপন কবা হয়। এর রূপকার্থ হচ্ছে, বর-কনে উভয়ে যেন জোয়াল-গ্রথিত বলদের হ্যায় যুক্তভাবে জীবনের সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার হয়।
তারপর কনেকে তার বাপের কোলে বসানো হয় এবং মন্ত্র উচ্চারণ ও ঢাকঢোলের বাজনার মধ্য দিয়ে বর-কনের গলায় থিরুমঙ্গলমটা বেঁধে দেওয়া হয়। বর মাত্র একটা গেরো দেয়, বাকী গেরো দেয় বরের বোনের। এর পরই “পাণিগ্রহণ” ও সপ্তপদীগমন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর বর-কনেকে হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করান হয় এবং কনের একটি পা পাথরের উপর রাখতে বলা হয়, যাতে স্বামীর প্রতি তার ভক্তি ও অনুরাগ পাথরের মত দৃঢ় হয়।
রাত্রে “শেষহোমম” সম্পাদন করে বর-কনেকে আকাশে ধ্রুব ও অরুন্ধতী নক্ষত্র দুটির প্রতি তাকাতে বলা হয়। তারপর “আশীৰ্বাদ” সম্পাদন করে বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ করা হয়। বর পরের দিন কনেকে নিয়ে তার নিজের বাড়ী চলে যায়। একে বলা হয় “গৃহপ্রবেশম”। বরের বাড়ী আর কোন অনুষ্ঠান হয় না।
মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটে বিবাহ একদিনেই শেষ হয়ে যায়। হরিয়ানায় কিন্তু দুদিন লাগে। মহারাষ্ট্রে মেয়ে পছন্দ হবার পর সকলকে সাক্ষী রেখে যৌতুকের জন্য ইয়াদী’ নামে এক চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। নগদ টাকা, অলঙ্কার প্রভৃতি থেকে আরম্ভ করে যা কিছু যৌতুকস্বরূপ দেওয়া হবে তা সব এই চুক্তিপত্রে লেখা থাকে। ইয়াদী-পত্র স্বাক্ষরিত হবার পর মেয়ের বাবা পাত্র সমেত পাত্র পক্ষের সকলকে তার গৃহে নিমন্ত্রণ করেন। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করেন ও তার সমক্ষে মেয়ের বাবা ছেলেকে ও ছেলের বাবা মেয়েকে “কুকুমতিলক” পরিয়ে দেন। এরপর ছেলের বাবা একটা জরি দিয়ে তৈরী ঠোঙায় করে মেয়ের হাতে কিছু মিষ্টি দেয়। এই অনুষ্ঠানকে “সাখবপুড়া” বলা হয়। ইহাই বিবাহের পাকা দেখা। বিয়ের আগের দিন সকালে মেয়ের বাড়ীতে হয় “বাঙ নিশ্চয়” অনুষ্ঠান আর সন্ধ্যাবেলা ছেলের বাড়ীতে হয় “সমস্ত পূজন” অনুষ্ঠান। বিয়ের দিন সকালে বর-কনে উভয়ের বাড়ীতেই অনুষ্ঠিত হয় “হলদী” বা গায়ে হলুদ। তারপর মেয়েরা দেওয়ালে চন্দ্র-সূর্য ও নানারকম মাঙ্গলিক চিহ্নের নকশা আঁকেন ও তার সামনে একটা উচু পিড়িতে একটি লক্ষ্মীমূর্তি স্থাপন করেন। একে বলা হয় “দেবক”। মেয়েকে এই লক্ষ্মীমূর্তির সামনে বসিয়ে রাখা হয়।