দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস এগুলির কোন ত্রুটি-বিচু্যতি ঘটলে বরকনে উভয়েরই অমঙ্গল ঘটবে। এগুলির উপর যে ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার প্রভাব আছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্ত্রী-আচারগুলিব উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহের পূর্বে যতরকম বাধাবিপত্তি ঘটতে পাবে সেগুলিকে প্রতিহত করা। আর পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত অনুষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে পবিত্রীকৃত করা । এসময় মৃত পুরুষদের আত্মার শাস্তিকামনা করা হয় ও দেবতাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করা হয়।
হিন্দুর জীবনে বিবাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আগেই বলা হয়েছে যে, মানুষকে পাপমুক্ত করে বিশুদ্ধিকরণ করবার জন্য হিন্দুর যে দশবিধ সংস্কার আছে তার মধ্যে বিবাহ হচ্ছে শেষ বা চরম সংস্কার । বিবাহ দ্বারা স্ত্রীলোকের কুলসম্পর্কের চু্যতি ঘটে। গোত্রদ্বারাই হিন্দুদের মধ্যে কুলসম্পর্ক সুচিত হয়। বিবাহের পর স্ত্রীলোককে পিতৃকুলের গোত্র পরিহার করে স্বামীর কুলের গোত্র গ্রহণ করতে হয়। সেজন্য হিন্দুনারীর পক্ষে বিবাহ-জীবন চরম সন্ধিক্ষণ। এরূপ সন্ধিক্ষণে যাতে কোন বাধা-বিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই আচার অনুষ্ঠান সমূহ পালিত হয়।
আচার-অনুষ্ঠানগুলির একটা সামাজিক উদ্দেশ্যও আছে। বরকনের মধ্যে যে বিবাহ ঘটছে এবং সে বিবাহ যে অবৈধ নয় সাধারণের মধ্যে তার প্রচার ও প্রকাশ করাও এই সকল আচার-অনুষ্ঠানের উদেশ্ব। সেজন্য জগতের সকল জাতির মধ্যেই বিবাহ উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিয়ম আছে, যদিও এসকল আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন রকমের। আবার একই দেশের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানগত রীতি বা প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের কথাই ধরুন । বিবাহের আচারঅনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক অংশ হিসাবে, পাঞ্জাবে “ফেরে” বা যজ্ঞকুণ্ডি প্রদক্ষিণ করা প্রথা প্রচলিত আছে। উত্তর প্রদেশের বহু স্থানে কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডি প্রদক্ষিণ করা হয় না। যেসব স্থানে বিবাহের জন্য মণ্ডপ নির্মিত হয় বা দণ্ড স্থাপিত হয় তাই প্রদক্ষিণ করা হয়। বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যায় কন্যার সিথিতে “সিন্দুর দান”-ই অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক প্রথা। আবার অনেক জায়গায় নিম্নশ্রেণীর মধ্যে র্কাটাদ্বারা আঙ্গুল থেকে রক্ত বের করে সেই রক্ত উভয়ে উভয়কে মাখিয়ে দেয়। মহারাষ্ট্র দেশে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা “প্রদক্ষিণ” প্রথা অনুসরণ করে। কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোকেরা বর-কনের উপর মাত্র চাউল, জল বা দুধ ছিটিয়ে দেয়। দক্ষিণ ভারতের প্রায় সর্বত্র “তালিবন্ধন” প্রথাই বিবাহের অপরিহার্য অঙ্গ ।
উপরে যে সমস্ত প্রথার কথা বলা হলো সেগুলো হচ্ছে মাত্র অপরিহার্য অংশ। এছাড়াও অনেক আড়ম্বরপূর্ণ ও বিশদ ধরনের আচার-অনুষ্ঠান আছে। এ সকল আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য একাধিক দিন লাগে এবং এগুলি পুরোহিত ও বাড়ীর মেয়েদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। সাধারণত পুরোহিত যে অনুষ্ঠানগুলি সম্পাদন করেন সেগুলি ধৰ্মীয় আচরণ আর মেয়েরা যেগুলি করে সেগুলি লোকাচার সম্পর্কিত। এই উভয়বর্গীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবদম্পতির সুখ, শাস্তি, আয়ু ও মঙ্গল কামনা করা।
পশ্চিম বাংলার বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সুতরাং এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া নিম্প্রয়োজন । মাত্র এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, এ সকল আচার-অনুষ্ঠান তিনদিন ব্যাপী স্থায়ী হয় এবং এতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে বর, কনে, নাপিত, পুরোহিত, বরের ও কনের বাবা ও মা, পাচ বা সাতজন সধবা স্ত্রীলোক ও কনের জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতি। স্ত্রী-আচারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে গায়ে হলুদ ও কলাতলা ও ছাদনাতলার আচারসমূহ, বৌভাত, ফুলশয্যা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির অন্তভুক্ত হচ্ছে পিতৃপুরুষদের প্রীতির জন্য আভু্যদয়িক ও কন্যাসম্প্রদান। ছাদনাতলার অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব করে নাপিত আর সম্প্রদানের অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব করে পুরোহিত । যেখানে কুশণ্ডিকা নেই সেখানে সম্প্রদানের পরই কন্যার সিথিতে সিন্দুরদান করা হয়। আর যেখানে কুশণ্ডিক আছে সেখানে পরের দিন কুশণ্ডিকার পর সিন্দুরদান করা হয়। বর পরের দিন কনেকে নিয়ে নিজের বাড়ী চলে যায়। ওই দিনের রাত্রিকে কালরাত্রি বলা হয় এবং ওইদিন বর-কনে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে না । তৃতীয় দিনে কস্তাকে পাককরা অন্নস্পর্শ করতে দেওয়া হয় এবং ওই অন্ন সে আত্মীয়স্বজনের পাতে দেয়। একে বৌভাত বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকাপাকিভাবে কনেকে পরিবারভুক্ত করা, যাতে তার স্পৃষ্ট অন্ন সকলে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে। সকলের শেষ অনুষ্ঠান, ফুলশয্যা । সেটা ওইদিনই রাত্রে হয়।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। ছাদনাতলায় স্ত্রী-আচারের সময় কনের জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতিকে কিছু কাপড়-চোপড় উপহার দেওয়া হয় । একে জামাইবৱণ বলা হয়। ১৯২৯ সালে বর্তমান লেখক “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া” পত্রিকায় এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে এক সময় শালীবরণ প্রথা ছিল এবং জামাইবরণ প্রথা তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। শালীবরণ বলতে বুঝায় একই সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করা। এক সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করার রীতি প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল। বিচিত্রবীর্য বিবাহ করেছিলেন অম্বিকা ও অম্বালিকাকে। নাভিও দুই যমজ ভগ্নীকে বিবাহ করেছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের ময়নামতীর গানে আমরা দেখি যে হরিশ্চন্দ্র গোপীচন্দ্রের সঙ্গে “অদ্ভুনার বিয়া দিয়া পছনা করিল দান” । এক সঙ্গে একাধিক ভগ্নীকে বিবাহ করার প্রথা না থাকলে এরূপভাবে অপর মেয়েকে দান করার কথা উঠতেই পারে না।