বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথা আদিবাসীসমাজেও প্রচলিত আছে। মধ্যপ্রদেশের ভীলদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রায়ই ঘটে থাকে। তাদের মধ্যে যে কোন কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। তবে যেক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ স্বরূপ স্ত্রীর চরিত্রের উপর দোষারোপ করা হয়, সে-ক্ষেত্রে স্বামী গ্রামের পঞ্চায়েতকে ডেকে তার সামনে নিজের মাথার পাগড়ি থেকে একখণ্ড কাপড় ছিড়ে নিয়ে. স্ত্রীকে দেয় এবং বলে যে, যেহেতু তার চরিত্রে তার আর আস্থা নেই সেইহেতু সে তাকে পরিহার করছে এবং ভবিষ্যতে সে তাকে ভগ্নীরূপে দেখবে। স্ত্রী ওই কাপড়ের টুকরাটি পিতৃগৃহে নিয়ে গিয়ে ঘরের চালের আড়ায় একমাস কাল ঝুলিয়ে রাখে। এর দ্বারা প্রচার করা হয় যে তার পূর্বস্বামী তাকে পরিহার করেছে এবং সে এখন দ্বিতীয়বার পতিগ্রহণের অধিকারিণী। একথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় স্বামী তার দেওয়া কন্যাপণ ফেরত নিয়ে নেয় ।
ভানটুদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয় বটে কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ খুব আনুকুল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয় না। ওড়িষ্যার পরোজাজাতির মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পছন্দ না করে বা তার সঙ্গে তার বনিবনা না হয় তবে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্ত । এদের মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পরিহার করে তবে তাকে বাধ্য করা হয় ৫ টাকা অর্থদণ্ড দিতে আর স্বামী যদি স্ত্রীকে বর্জন করে তবে তাকে মাত্র এক টাকা অর্থদণ্ড দিতে হয় । ত্রিবাঙ্কুরের জাতিসমূহের মধ্যেও বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রচলিত আছে। কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাডাক উপত্যকার অধিবাসীদের মেয়েরাও খুশীমত বিবাহ বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
বিধবা বিবাহ আদিবাসীসমাজে খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে সাধারণত যে নিয়ম দেখতে পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে—কোন বিশেষ আত্মীয়-এর সঙ্গে বিধবার বিবাহ হওয়া চাই । তবে মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যে এরূপ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। তাদের মধ্যে বিধবার সম্মতি পেলে বিবাহপ্রার্থী ব্যক্তি ৪৫ জন বন্ধু-বান্ধবসহ কিছু উপহার সামগ্রী ও বস্ত্র নিয়ে বিধবার বাড়ী যায় ও বিধবার ভাইয়ের স্ত্রীকে বা তার পিসিকে সাত পয়সা দক্ষিণা দেয়। এরূপক্ষেত্রে ভাইয়ের স্ত্রী বা পিসি সধবা হওয়া চাই। তারপর ভোজ ও মদ্য পান করে বিবাহ নিম্পন্ন করা হয় । এরূপ বিবাহ সাধারণত রাত্রিকালে হয় এবং নবপরিণীত বিধবা- কখনও দিবালোকে তার স্বামীর গৃহে যায় না। কেননা, তাদের বিশ্বাস যে দিবালোকে স্বামীগৃহে গেলে দেশে তুর্ভিক্ষ হয়। এরূপ বিবাহের পর বিধবার বা তার ছেলেদের প্রথম স্বামীর সম্পত্তিতে কোন উত্তরাধিকার থাকে না। যেক্ষেত্রে এরূপ বিবাহ দেবরের সঙ্গে হয় সেক্ষেত্রে যদি প্রথম স্বামীর ছেলে থাকে তা হলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তান কখনও প্রথম স্বামীর সম্পত্তি পায় না। কিন্তু যদি প্রথম স্বামীর কোন ছেলে না থাকে তা হলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তানরাই প্রথম স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয় ৷ ভীলদের মধ্যে বিধবা বিবাহও প্রচলিত আছে ; কিন্তু এদের মধ্যে হিন্দুসমাজ দ্বারা প্রভাবান্বিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা এর অনুমোদন করে না। বারওয়ানির পাতলি, রথিয়া ও তারভিজাতি সমূহের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। নীলগিরির কুরুস্বরাও বিধবা বিবাহ অনুমোদন করে। ওড়িষ্যার পরোজাদের মধ্যে বিধবাকে বাধ্যতামূলকভাবে দেবরকে বিবাহ করতে হয় । বিধবা যেক্ষেত্রে দেবরকে বিবাহ করতে অস্বীকৃত হয় সেক্ষেত্রে বিধবা যাকে বিবাহ করবে তাকে পঞ্চায়েত কর্তৃক নির্দিষ্ট অর্থদণ্ড দেবরকে দিতে হয়। ত্রিবাস্কুরের মুড় বুনদের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে তবে এদের মধ্যে দেবর বা অন্য কোন স্বজনকে বিবাহ করা সম্বন্ধে কোন বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। কিন্তু ত্রিবাঙ্কুরের মান্নানদের মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। তাবার ত্রিবাঙ্কুরের কুরুস্ব পুলায়ানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারও অধিকার আছে কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে বিবাহ করবার। কিন্তু উল্লটনরা মাত্র দেবরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেয়। আসামের গারোদের মধ্যে জামাতা কর্তৃক বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করার রীতি আছে। আসামের বাগনি, দাফল ও লাখেরদের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর বিধবা-বিমাতাকেই সস্তান স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে। এ সমাজে পুরুষ সাধারণত অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ করে, যাতে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে কন্যাপণ এড়িয়ে বিমাতাকে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করতে পারে। মধ্যপ্রদেশের ভানটুদের মধ্যে বিধবার যদি অনেকগুলি ছেলেমেয়ে থাকে তাহলে সে বিবাহ না করে অপর পুরুষের সঙ্গে যথেচ্ছা যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত হতে পারে।
০৭. বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান
হিন্দুর দৃষ্টিতে বিবাহ অবশ্য করণীয়ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশুদ্ধিকরণেব জন্য হিন্দুদের যে দশবিধ সংস্কার আছে, বিবাহ তার মধ্যে শেষ সংস্কার। অবশু করণীয় ধর্মীয় আচরণ বলে বিবাহ ব্যাপারে হিন্দুদের নানা আচার-অনুষ্ঠানের অনুবতী হতে হয়। এ সকল আচারঅনুষ্ঠানগুলিকে দুভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে—স্ত্রী-আচার ও পুরোহিত কর্তৃক সম্পাদিত ধর্মীয় আচার। স্ত্রী-আচার বাড়ীর মেয়েদের মধ্যে যারা সধবা তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। মেয়েলীসমাজে পুরোহিত কর্তৃক ধর্মীয়-আচারের চেয়ে স্ত্রী-আচারের উপর বেশী জোর