একাধিক পতির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি নীলগিরি পাহাড় অঞ্চলের টোডাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। ত্রিবাঙ্কুরেব মুড় বন, মল-পুলায়ণ ও মল-আরয়নদের মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ একসময় প্রচলিত ছিল, কিন্তু এখন তা বিরল। উল্লাটানদের মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতি গ্রহণ কখন কখনও দেখা যায়, যদিও ওটা তাদের মধ্যে সাধারণ রীতি নয়। হিমালয়ের সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি উপজাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ প্রচলিত আছে।
টোডাদের মধ্যে অস্তর্বিবাহমূলক দুটি বিভাগ আছে। এ-দুটি বিভাগের নাম হচ্ছে টারথার ও টিভালি। টারথারগণ নিজেদের টিভালি অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করে। দুটি বিভাগই হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। তার মানে টারথারদের সঙ্গে টিভালিদের কখনও বিবাহ হয় না। টারথারদের বিভাগে ১২টি ও টিভালিদের বিভাগে ৬টি গোত্র আছে। বিবাহ সব সময় নিজ গোত্রের বাহিরে হয়। টোডাদের মধ্যে মামাতে ও পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের রীতিও প্রচলিত আছে। কিন্তু টোডাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যমূলক বৈবাহিক আচরণ হচ্ছে বহুপতি গ্রহণ। টোডাদের মধ্যে যে বহুপতিক বিবাহের চলন আছে তা হচ্ছে ভ্রাতৃত্বমূলক। তার মানে একাধিক ভ্রাতা একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করে। অনেক সময় ভ্রাতৃগণ সহোদর না হয়ে দলভুক্ত ভ্রাতাও হন। টোডাদের মধ্যে সন্তানের পিতৃত্ব “পুরুসুৎ পুমি” নামে এক অনুষ্ঠানের দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। স্ত্রীর ৭ মাস গর্ভকালে স্বামীদের মধ্যে একজন ধনুর্বান নিয়ে এই অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করে এবং সে-ই জাতসন্তানের পিতারূপে পরিচিত হয়। যতদিন না অপর কোন স্বামী অনুরূপ অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করছেন ততদিন অনুষ্ঠানকারী স্বামীই সমাজে সন্তানের পিতারূপে গণ্য হয় । যেক্ষেত্রে স্বামীরা সকলে একত্রে বাস করে না বা ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে বাস করে সে-ক্ষেত্রে স্ত্রী পালা করে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে একমাস কাল করে বাস করে।
কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাডাক উপত্যকার অধিবাসী লাডাকিদের মেয়েরাও বহুপতি গ্রহণ করে । তাদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাধারণত জ্যেষ্ঠ ভাইই বিবাহ করে কিন্তু সেই বিবাহিতা স্ত্রী তার কনিষ্ঠ ভাইদেরও স্ত্রীরূপে পরিগণিত হয়। তবে যেখানে অনেকগুলি ভাই থাকে সেক্ষেত্রে ওই সম্পর্ক মাত্র তিন চার ভাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী ভাইয়ের কোন মঠের অন্তভুক্ত হয়ে লামার জীবনযাপন করে। তবে যেক্ষেত্রে কনিষ্ঠ ভাই এরূপভাবে মঠে প্রবেশ করে না সেক্ষেত্রে সে “মাগপা” স্বামী হিসাবে কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারে। *মাগপা” স্বামীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় । তাকে সব সময় স্ত্রীর বশীভূত হয়ে থাকতে হয় এবং স্ত্রী যখন খুশী তখন তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আবার নূতন “মাগপা” গ্রহণ করতে পারে। তবে দ্বিতীয় স্বামীর অবস্থাও প্রথম স্বামীরই অনুরূপ। তার সঙ্গেও স্ত্রী যে কোন সময় খুশীমত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে লেপচাজাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ সীমিতভাবে প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে এদের মধ্যে প্রথার কিছু বৈচিত্র্য আছে। সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন চাষবাসের কাজ একা করতে অসমর্থ হয় বা তাকে অন্য কাজে ব্যাপৃত থাকতে হয় তখন সে প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে কোন অবিবাহিত যুবককে তার মাঠের কাজ করবার জন্য এবং তার দাম্পত্য শয্যার অংশীদার হতে আহবান করে নেয়। এক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না । এই দ্বিতীয় স্বামী কখনও নিজের বাবদে স্বতন্ত্র বিবাহ করতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি হচ্ছে এই যে, স্ত্রী পর্যায়ানুক্রমে একান্তর রাত্রিতে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করবে। তবে যে-কোন স্বামীর দ্বারা সন্তান উৎপন্ন হউক না কেন সে সন্তান প্রথম স্বামীর ঔরসজাত বলে পরিচিত হবে। কেবল প্রথম স্বামী যদি দীর্ঘকালের জন্ত বিদেশে যায় এবং তার দ্বারা সন্তান উৎপাদন অসম্ভাব্য হয় তা হলে সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্বামীকেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য করা হয়।
হিমালয়ের পাদদেশের জৌনসর বেওয়া অঞ্চলের খস জাতীয় অধিবাসীদের মধ্যেও বহুপতি গ্রহণ প্রথা প্রচলিত আছে। উত্তর ভারতের জাটজাতির দরিদ্রশ্রেণীর মধ্যে ও কেরালার নায়ারদের মধ্যে বহুপতিক বিবাহ দেখা যায়। কেরালার স্বর্ণকার বৃত্তিধারী আশরীজাতির মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিক বিবাহের চলন আছে। ভারতের বাইরে তিববতেও বহুপতিক বিবাহ আছে। প্রাচীন আর্যদের মধ্যেও যে বহুপতিক বিবাহের প্রথা ছিল তা তো আগেই বলা হয়েছে। এক সময় এরূপ বিবাহ ইউরোপেও প্রচলিত ছিল ।
যে-সমাজে স্ত্রীলোককে জননশক্তির আধার ও আর্থিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয় সে-সমাজ যে বাল্যবিবাহ বরদাস্ত করবে না, তা বলাই বাহুল্য। এ কারণে আদিবাসীসমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন নেই। মাত্র যারা হিন্দুসমাজের প্রভাবের আওতায় এসেছে তাদের মধ্যেই কখন কখনও বাল্যবিবাহ দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত স্ত্রী-পুরুষের যৌবনপ্রাপ্তির পূর্বে বিবাহ আদিবাসীসমাজে খুবই বিরল। মধ্যপ্রদেশের ভীলেদের মধ্যে ১৫ থেকে ৪০ বছর হচ্ছে মেয়েদের বিবাহের প্রচলিত বয়স। ত্রিবাঙ্কুরের উপজাতি সমূহের মধ্যে ১৫ বৎসরের পূর্বে কখনও মেয়েদের বিবাহ হয় না। প্রায় সমস্ত আদিবাসীসমাজেই মেয়েদের বিবাহের বয়স পনের-র বেশী ।