আদিবাসীদের মধ্যে বিবাহের জন্য যে সামাজিক সংগঠন আছে এতক্ষণ সে সম্বন্ধেই বলা হলো। এবার আদিবাসী সমাজে বিবাহের রকমফেরের কথা কিছু বলা যাক। একথা আগেই বলা হয়েছে যে প্রাচীন ভারতে রাক্ষস, আস্থর ইত্যাদি বিবাহপ্রথা আর্যগণ কর্তৃক আদিবাসী সমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। রাক্ষস বিবাহ বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যে প্রচলিত আছে। এরূপ বিবাহকে ভীলেরা “ঘিসকরলেজানা” বলে। তার মানে যে বিবাহে মেয়েকে কেড়ে আনা হয়েছে। ৩০৪০ বছর আগে পর্যন্ত এরূপ বিবাহ সচরাচর ঘটতো । এরূপ বিবাহের প্রশস্ত সময় ছিল ভাগোরিয়া উৎসবের দিন। ভাগোরিয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হতো হোলিপর্ব উপলক্ষে “মেড়।” পোড়ানোর আগের দিনে। সাধারণত বর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কোন গ্রামে প্রবেশ করতে ও মেয়েটিকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আসতো । তারপর একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে নিয়মানুগত করে নেওয়া
হতো । মধ্যপ্রদেশের চানডা ও বস্তাব জেলার গোগুদের মধ্যেও পূর্বে এরূপ বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এরূপ বিবাহকে দণ্ডবিধি আইন অনুসারে অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তি দেওয়ার ফলে আদিবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে এ সম্পর্কে এক বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেছে। এরা প্রথমে বর-কনের মধ্যে বিবাহ স্থির করে এবং পরে বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার সময় পুৰ্বকালেব রীতি অনুযায়ী কনেকে কেড়ে নেওয়ার একটা কপট অভিনয় কবে মাত্র। দক্ষিণ ভাবতে ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বনদের মধ্যেও মেয়ে কেড়ে নিয়ে এবকম বিবাহেব প্রচলন আছে।
যেখানে মেয়েকে এভাবে কেড়ে নিয়ে আসা হতো সেখানে একদলের সঙ্গে অপর দলের যে দ্বন্দ্ব হতো সে দ্বন্দ্ব যে অনেক সময চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বে পরিণত হতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এরূপ দ্বন্দ্ব পরিহারের জন্য উভয় দলের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বভাবে কন্যাবিনিময় প্রথার উদ্ভব হয় । কন্যা-বিনিময় প্রথার পিছনে যে যুক্তি আছে তা হচ্ছে স্ত্রীলোক জননশক্তির উৎস। কোন স্ত্রীলোককে যদি কেহ দল থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় তা হলে দলের জননশক্তির ভাণ্ডার হ্রাস পায় । সুতরাং কন্যা-বিনিময় দ্বারা ঐ ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া উপজাতিসমাজে মেয়েরা নিজ শ্রম দ্বারা দলের অর্থনৈতিক উৎপাদনে সাহায্য করে। সেইহেতু তারা দলের আর্থিক সম্পদ স্বরূপ। বিবাহের পর কন্যা অপর দলে চলে গেলে আর্থিক সম্পদ ভাণ্ডারের যে ক্ষয় ক্ষতি হয় তা পূরণ করাও কন্যা-বিনিময় প্রথার উদ্দেশ্য। কন্যা-বিনিময় প্রথা ত্রিবাঙ্কুরের পাহাড়িয়া পানতারাম ও উরালীদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। বস্তুত উরালীদের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণভাবে বিনিময় প্রথার উপর স্থাপিত। এদের সমাজে কন্যাপণ দিয়ে স্ত্রী পাওয়া যায় না। যখন কোন যুবক বিবাহ করতে চায় তখন তাকে নিজের কোন বা অপর কোন আত্মীয়াকে অপর দলের হাতে সমর্পণ করে তবে স্ত্রী সংগ্ৰহ করতে হয়। এরূপ বোন বা আত্মীয়া যে যুবতী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে-কোন বয়সের বোন বা আত্মীয়া হলেই চলে, কেবল তাকে স্ত্রীলোক হতে হবে। এই কারণে আগেকার দিনে উরালীসমাজে কোন যুবকের যতগুলি বোন থাকতো তার ততগুলি বিবাহ করবাব সম্ভাবনা ছিল ।
আর এক রকম রাক্ষস বিবাহ আদিবাসীসমাজে প্রচলিত আছে । একে বলা হয় “সিন্দুর ঘষা” বিবাহ। সিন্দুর ঘষা বিবাহ অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে । এটা বিশেষ করে প্রচলিত আছে আমাদের ঘরের কাছে সাঁওতালসমাজে । এ বিবাহে পুরুষ হাটে বা বাজারে জোর কবে কোন মেয়ের সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেয়। সিন্দুর ঘষে দেবার পর উভয়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হয়ে যায়। মেয়ে যদি বরকে পছন্দ না করে তা হলেও তার সঙ্গে তাকে ঘর করতে হয়। তার কারণ, সিন্দুর-ঘষা মেয়েকে সমাজে আর কেউ বিবাহ করে না।
অসুর বিবাহ রাক্ষস বিবাহেরই এক অমুকৌশল মাত্র। যেস্থলে কোন কারণবশত কন্যা বিনিময় করা সম্ভবপর হতো না সেস্থলে কস্তার পরিবর্তে তার মূল্য ধরে দেওয়া হতো, যাতে অপর দল ঐ পণের বিনিময়ে অপর কোন দল থেকে কন্যা ক্রয় করে দলের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে পারতো। এইভাবে কন্যাপণ প্রথার উদ্ভব হয়েছিল। কন্যাপণ যে মাত্র টাকা-পয়সাতেই দেওয়া হয়, তা নয়।
অনেক সময় কন্যাপণ অন্তরকম ভাবেও দেওয়া হয় । যেমন—শ্রমদান করে। এ সম্পর্কে মনে রাখতে হবে যে পণ দিয়ে মেয়ে কেনা ঠিক ক্রীতদাসী কেনা বা অন্ত পণ্যদ্রব্য কেনার মত নয়। কেননা ক্রীতদাসী বা ক্রীত তান্ত পণ্যদ্রব্য ক্রেতা আবার বেচতে পারে। কিন্তু যেখানে কন্যাপণ দিয়ে বিবাহ করা হয় সেখানে মেয়েকে আবার বেচা যায় না। বস্তুত যা কেনা হয় সেটা হচ্ছে কন্যার সন্তানপ্ৰসবিনী ক্ষমতা । সেই কারণে দেখতে পাওয়া যায় যে, যেখানে স্ত্রী অনুর্বরা হয় সেখানে তাকে সহজে বিচ্ছেদ করা যায়।
আদিবাসীসমাজে কন্যাপণ প্রথা বহুবিস্তৃত। বস্তুত এমন কোন উপজাতি নেই যাদের মধ্যে কোন-না-কোনভাবে কন্যাপণ প্রথা প্রচলিত নেই । কন্যাপণের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রকম। পূর্বে কন্যাপণ নামমাত্ৰ পাচ টাকা মূল্য থেকে একশত টাকা বা তার বেশী ছিল। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের ভানটুদের মধ্যে কন্যাপণের পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ টাকা হতো। মধ্যপ্রদেশে কোলজাতির মধ্যে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১২০ টাকা । বারওয়ানীর রথিয়৷ ভীলদের মধ্যে এর পরিমাণ ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মাণ্ডালা ও বালাঘাটের বাইগাদের মধ্যে কম্বাপণ ছিল ৫ টাকা থেকে ৯ টাকা। কোচিনের কাদারদেব মধ্যে এক সময় কন্যাপণ বনজ পণ্যসামগ্ৰী দিয়ে চুকানো হতো, কিন্তু এখন তা টাকাপয়সায় মেটানো হয় ।