ওড়িষ্যার কোরাপুট জেলার পরোজাদের মধ্যেও বহিবিবাহের জন্য গোত্রবিভাগ দেখা যায়। ওড়িষ্যার পারলাকিমেদির শবরদের মধ্যেও গোত্রবিভাগ আছে। তবে এ সকল ক্ষেত্রে গোত্রগুলি টটেমভিত্তিক নয়, এগুলি গ্রামভিত্তিক। তার মানে একই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কখনও বিবাহ হয় না। এক গ্রামের মেয়েকে বিবাহ করতে হয় অপর গ্রামের ছেলেকে । তাদের বিশ্বাস এই যে একই গ্রামের ছেলেমেয়ের পরস্পর ভাইবোন। সুতরাং তাদের মধ্যে কখনও বিবাহ হতে পারে না। তবে কোন নবাগন্তুক এসে যদি গ্রামে বাস করে তবে তার সঙ্গে তারা গ্রামের মেয়ের বিয়ে দেয় । তামিলনাড়র বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি হয় টটেমভিত্তিক আর তা নয় তো গ্রামভিত্তিক। কোচিনের কাদার উপজাতির মধ্যে যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীসমূহ আছে সেগুলি সবই গ্রামভিত্তিক। সেখানে তারা একই গ্রামের মধ্যে কখনও ছেলেমেয়ের বিবাহ দেয় না।
ত্রিবাছুরের উপজাতিসমূহের মধ্যেও বহির্বিবাহের গোষ্ঠী আছে। এগুলি দলভিত্তিক। কিন্তু পাহাড়ীয়া পান্তারামদের মধ্যে কোন দল বিভাগ নেই। তাদের মধ্যে তিন চারটি করে পরিবার নিয়ে এক একটি বহির্বিভাগের গোষ্ঠী গঠিত হয়। তবে এ সকল গোষ্ঠীর কোন স্বতন্ত্র নাম নেই।
ত্ৰিবান্দ্রমের কানিকাররা চারটি দলে বিভক্ত। এই চারটি দলের নাম হচ্ছে—মুট্টা-ইলোম,মেন-ইলোম, কায়-ইলোম এবং পাল-ইলোম। ইলোম শব্দের অর্থ হচ্ছে গোত্র। এদের মধ্যে মুট্টা-ইলোম ও মেন-ইলোম দল নিজেদের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ মনে করে। এই দুটি দলের মধ্যে এক দলের ছেলেমেয়ের সঙ্গে অপরদলের ছেলেমেয়ের বিবাহ হয় কিন্তু অপর দুটি দলের সঙ্গে এদের কোন বৈবাহিক আদান-প্রদান নেই। তবে এ ক্ষেত্রে চারটি দলেরই বহির্বিবাহের গোষ্ঠী আছে এবং বিবাহের সময় তারা নিজেদের গোষ্ঠী বর্জন করে। ত্রিবান্দ্রমের আর এক জায়গায় কানিকাররা দুটি শাখায় বিভক্ত—আম্নন-থামবি ও মাচামবি । অল্পন-থামবিরা মেন-ইল্লোম, পেরিন-ইল্লোম ও কায়-ইল্লোম দলে বিভক্ত আর মাচামবিরা বিভক্ত মুট-ইল্লোম, বেলানট-ইল্লোম ও কুরু-ইল্লোম দলে। এদের মধ্যে এক দলের ছেলের সঙ্গে কখনও অপর দলের মেয়ের বিবাহ হয় না। এক সময় এদের মধ্যে যে মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের প্রচলন ছিল তা তাদের সন্তানদের দলভুক্তি থেকে বোঝা যায়। যেমন—কুরু-ইল্লম দলের স্বামীর ঔরসে পেরিনইল্লম দল থেকে আনীত স্ত্রীর গর্ভে যে সস্তান হয় সে মাতার দলভুক্ত হয়, কখনও পিতার দলের লোক বলে পরিচিত হয় না। ত্রিবাঙ্কুরের মাল-আরায়নদের মধ্যেও সস্তান মাতার দলভুক্ত হয়, কখনও পিতার দলভুক্ত হয় না। আবার মল-বেদনদের মধ্যে বিবাহের পর স্ত্রী কখনও নিজের দলচু্যত হয় না এবং সস্তান মাতারই কুল পায়। উরালীদের মধ্যেও সন্তান মায়েরই কুল পায়, পিতার নয়। মান্নানদের মধ্যেও এই নিয়ম প্রচলিত।
আসামের উপজাতিসমূহ মঙ্গোলীয় মানবশাখার অন্তভূক্ত। এদের মধ্যে পিতৃকেন্দ্রিক ও মাতৃকেন্দ্রিক উভয় প্রকারের সমাজই প্রচলিত আছে। খাসিয়ার মাতৃকেন্দ্রিক। তারা পাচটি শাখায় বিভক্ত। আবার প্রতি শাখার মধ্যে অসংখ্য বহিবিবাহের দল বা উপদল আছে। আসামের মিকিরজাতির সমাজব্যবস্থা পিতৃকেন্দ্রিক। এরা পাচটি দলে বিভক্ত। প্রতিদলের মধ্যে বিভিন্ন উপদল আছে। মাত্র উপদলগুলিই বহির্বিবাহের দল হিসাবে ক্রিয়াশীল। দলের ভেতর কখনও বিবাহ হয় না। কেননা এদের বিশ্বাস যে, দলের সকলেই পরস্পরের ভাইবোন। সেই কারণে তাদের মধ্যে বিবাহ হতে পারে না। লাখেরদের মধ্যে কিন্তু এ সম্বন্ধে কোন বাধাধরা নিয়ম নেই, তারা ইচ্ছামত দলের বাইরে বা ভেতরে বিবাহ করতে পারে। কাছারের পাহাড়ী কাছারীরা ২০টি দলে বিভক্ত। এদের সাতটি দলকে “পুরুষ” দল বলা হয় আর ১৩টিকে বলা হয় “মেয়ে” দল। এদের মধ্যে ছেলেরা কখনও মায়ের দলে ও মেয়েরা কখনও বাপের দলে বিয়ে করতে পারে না। উত্তর কাছারের কুকীরা চারটি দলে বিভক্ত। এখানে দলগুলি অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কার্যকর থাকলেও এক দলের ছেলের সঙ্গে অপর দলের মেয়ের বিবাহ বিরল নয়। যেখানে এরূপ দলের বাইরে বিবাহ হয় সেখানে বিবাহের পর নারী স্বামীর দলাখ্যা পায়। কিন্তু খেলমাকুকীদের মধ্যে স্বতন্ত্র নিয়ম পরিলক্ষিত হয়। এখানে দলগুলি অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে ক্রিয়া করে। অনেক সময় একদলের সঙ্গে অপর দলের ছেলেমেয়েদের বিবাহ হয় বটে কিন্তু এরূপ বিবাহ দূষিত বলে গণ্য হয় এবং যে ক্ষেত্রে এরূপ বিবাহ হয় সেক্ষেত্রে সেই পুরুষ পিতা-মাতার শ্রাদ্ধাদি কাজের অধিকারী হয় না। একারণে প্রতি পরিবারেরই লক্ষ্য থাকে ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধাদির জন্ত পরিবারের অন্তত একজন যেন নিজ
দলে বিবাহ করে। তবে এরূপ দলবহিভূত বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী কখনও স্বামীর দলাখ্যা পায় না।
আদিবাসীদের সমাজ সংগঠনের যে সমীক্ষা এই অধ্যায়ে দেওয়া হলো তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আদিবাসী সমাজে বহির্বিবাহ সাধারণভাবে প্রচলিত। আদিবাসীদের মধ্যে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি টটেমভিত্তিক বা গ্রামভিত্তিক বা যে রকম ধরণেরই হউক না কেন, তাদের বিশ্বাস যে বহির্বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর সম্পর্ক হচ্ছে ভাইবোনের সম্পর্ক এবং সেই কারণে সেই গোষ্ঠীর মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিবাহ হতে পারে না। আদিবাসীরা কেন নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ করে না সে সম্বন্ধে তাদের প্রশ্ন করলে তাদের কাছ থেকে নিয়ত এই উত্তরই পাওয়া যায়। এটা সকলেরই জানা আছে যে জগতের সর্বত্র পরিবারই বহির্বিবাহের ক্ষুদ্রতম সংস্থা হিসাবে ক্রিয়া করে। কেননা পরিবারের মধ্যে যৌনমিলন অজাচার স্বরূপ গণ্য হয়। নৃতত্ত্ববিদগণের মধ্যে অনেকে মনে করেন যে পরিবারের মধ্যে যৌনাচার সম্পর্কে যে অলঙ্ঘনীয় বিধিনিষেধ আছে তা থেকেই দলগত বা গোষ্ঠীগত বহির্বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে।