আদিম -মানবের পরিবার ছিল অনেকটা পাশ্চাত্য দেশসমূহে আজকাল যে রকম পরিবার দেখতে পাওয়া যায়, তারই মত। পিতামাতা ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সস্তানদের নিয়েই এই পরিবার গঠিত হতো। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবার ছিল স্বতন্ত্র রকমের। এ পরিবার ছিল অধিকতর বিস্তৃত। এ ছাড়া পাশ্চাত্য দেশের পরিবারের সঙ্গে ভারতের পরিবারের এক মূলগত পার্থক্য ছিল। ভারতের পরিবার ছিল অবিচ্ছেদ্য । একমাত্র যমরাজা বিচ্ছেদ না ঘটালে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক কখনও বিচ্ছিন্ন হতো না। তার কারণ পাশ্চাত্য জগতের হ্যায় ভারতে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রথা প্রচলিত ছিল না । ভারতের পরিবার ছিল স্থায়ী পরিবার। এর পরিধি ছিল অতি বিস্তৃত। এজন্য একে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার বলা হতো। এই পরিবারের মধ্যে বাস করতে স্বয়ং ও তার স্ত্রী, স্বয়ং-এর বাবা-মা, খুড়ো-খুড়ি, জেঠ-জেঠাই, তাদের সকলের ছেলে-মেয়ের, স্বয়ং-এর ভাইয়েরা ও তাদের স্ত্রীরা ও ছেলেমেয়েরা এবং নিজের ছেলেমেয়েরা। অনেক সময় এই পরিবারভুক্ত হয়ে আরও থাকতে কোন বিধবা পিসি বা বোন বা অন্ত কোন দুঃস্থ আত্মীয় ও আত্মীয়া। যোগাযোগ ও পরিবহনের সুবিধা হবার পর মানুষ যখন কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে গিয়ে বসবাস সুরু করলো, তখন থেকেই ভারতের এই সনাতন পরিবারের ভাঙ্গন ঘটলো ।
একই রকমের পরিবার ভারতের সর্বত্র দেখা যায়না । উপরে যে পরিবারের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে, তাকে বলা হয় পিতৃশাসিতপিতৃকেন্দ্রিক পরিবার। দেশের অধিকাংশ স্থানেই এই পরিবার দেখা যায়। পিতৃশাসিত-পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারের বৈশিষ্ট্য এই যে, এরূপ পরিবারে বংশপরম্পর নির্ণীত হয় পিতা, পুত্র বা পৌত্রের মাধ্যমে। এক কথায়, এরূপ পরিবারে বংশপরম্পরা নেমে আসে পুরুষের দিক দিয়ে। সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতিতে গঠিত যে পরিবার ভারতে দেখা যায়, তাকে বলা হয় মাতৃশাসিত-মাতৃকেন্দ্রিক পরিবার। এরূপ পরিবারে বংশপরম্পরা নির্ণীত হয় মেয়েদের দিক দিয়ে, মাতা, কস্তা, দৌহিত্রী ইত্যাদির মাধ্যমে। মাতৃশাসিত-মাতৃকেন্দ্রিক পরিবার গঠিত হয় স্ত্রীলোক স্বয়ং, তার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ এবং নিজের ও ভগিনীদের সস্তান-সন্ততিদের নিয়ে। পিতৃশাসিত পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারের আর এক বৈশিষ্ট্য এই যে, বিবাহের পর স্ত্রী এসে বাস করে তার স্বামীর গৃহে। কিন্তু মাতৃশাসিত মাতৃকেন্দ্রিক পরিবারে এরূপ ঘটে না। এই পরিবারের কোন স্ত্রীলোক বিবাহের পর অন্যত্র গিয়ে বাস করে না। এরূপ পরিবারের অন্তভুক্ত পুরুষদের স্ত্রীরা এবং স্ত্রীলোকদিগের স্বামীরা অন্য পরিবারে বাস করে। স্ত্রীলোকদের স্বামীরা মাত্র সময় সময় আসা যাওয়া করে। বলা বাহুল্য পিতৃশাসিত পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারে স্ত্রী স্বামীর ও সন্তানর পিতার সাহচর্য পায়। মাতৃশাসিত মাতৃকেন্দ্রিক পরিবারে তা পায় না।
পিতৃশাসিত পিতৃকেন্দ্রিক পরিবারই ভারতে প্রাধান্ত লাভ করেছে। উত্তর ভারতের সর্বত্র এই পরিবারই দৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ স্থলেও তাই। তবে দক্ষিণ ভারতে এমন অনেক জাতি ও উপজাতি আছে যাদের মধ্যে মাতৃশাসিত মাতৃকেন্দ্রিক পরিবারই প্রধান। এরূপ জাতির অন্যতম হচ্ছে মালাবার উপকূলের নায়ার ও তিয়ান জাতি এবং কর্ণাটকের বানটু ও তুলুভাষাভাষী অনেক জাতি। তামিল নাড়ুর পরিবার প্রধানত পিতৃকেন্দ্রিক ও পিতৃশাসিত। তবে তামিল নাড়র দক্ষিণ অঞ্চলে এমন কয়েকটি জাতি আছে যাদের মধ্যে উভয় বর্গের পরিবারই দেখা যায়। উত্তর ভারতে মাতৃকেন্দ্রিক মাতৃশাসিত পরিবার অত্যন্ত বিরল। বোধ হয় আসামের খাসি ও গারো জাতির পরিবারই এ সম্পর্কে একমাত্র ব্যতিক্রম।
ভারতে ভূ-রকমের সমাজ ব্যবস্থা দেখা যায়। আদিবাসীর সমাজ ব্যবস্থা ও হিন্দুর সমাজ ব্যবস্থা। উভয় রকম সমাজ ব্যবস্থাতেই পরিবার হচ্ছে নূ্যনতম সামাজিক সংস্থা। আদিবাসীদের মধ্যে কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হয় একটি গোষ্ঠী বা দল। আবার কয়েকটি গোষ্ঠী বা দলের সমষ্টি নিয়ে গঠিত হয় একটি উপজাতি বা ট্রাইব। হিন্দুদের মধ্যে ট্রাইবের পরিবর্তে আছে বর্ণ কিংবা জাতি। এগুলির আবার অনেক শাখা ও উপশাখা আছে।
হিন্দুর জাতিই বলুন আর আদিবাসীর ট্রাইবই বলুন, এগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্তর্বিবাহ। তার মানে, কেউ নিজ জাতি বা ট্রাইবের বাইরে বিবাহ করতে পারে না। বিবাহ করতে হলে জাতি বা ট্রাইবের ভেতরেই বিয়ে করতে হবে। তবে জাতি বা ট্রাইবের ভেতর যে কোন পুরুষ যে কোন মেয়েকে অবাধে বিয়ে করতে পারে না। এ সম্বন্ধে উভয় সমাজেই খুব সুনির্দিষ্ট নিয়ম কামুন আছে।
আগেই বলা হয়েছে যে জাতি বা ট্রাইবগুলি কতকগুলি গোষ্ঠী বা দলে বিভক্ত। এই সকল গোষ্ঠী বা দলগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহিবিবাহ। তার মানে কোন গোষ্ঠীর কোন ছেলে যদি বিয়ে করতে চায় তবে তাকে বিয়ে করতে হবে অন্ত গোষ্ঠীর মেয়েকে, নিজের গোষ্ঠীতে নয়। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, যদি কেউ বিয়ে করতে চায়, তাহলে তাকে নিজের জাতির ভেতরেই বিবাহ করতে হবে, কিন্তু নিজের গোষ্ঠীতে নয়, অপর কোন গোষ্ঠীতে। এ নিয়ম না মানলে, কিছুকাল আগে পর্যন্ত একঘরে হয়ে থাকতে হতো এবং আগেকার দিনে একঘরে হয়ে থাকাটা এক ভয়াবহ শাস্তি ছিল।