এত সব বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও হিন্দুসমাজের বিধান ছিল যে, বিবাহ সকলকে করতেই হবে। কেননা বিবাহ না করলে পুত্র আসবে কোথা থেকে, যে পুত্র পূর্বপুরুষদের স্বর্গে যাবার পথ পরিষ্কার করে দেবে। এই কারণে, হিন্দুসমাজে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক। বিবাহ ব্যাপারে হিন্দুসমাজে সকলেরই যোগ্যতা আছে । তা সে কানা, খোড়া, পঙ্গু বা আর যা কিছুই হোক না কেন। বিবাহের যোগ্যতা সম্পর্কে হিন্দুসমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গী, আধুনিককালের আদালত কর্তৃকও সমর্থিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, যার যত খুশী, বিবাহ করতে পারতো। বঙ্গদেশের কুলীন ব্রাহ্মণরা তো বস্তা বেঁধে বিবাহ করতেন ! এরূপ শোনা যায় যে, এক একজন ২০০৩০০ পর্যন্ত বিবাহ করতেন। আজকের দিনে হিন্দু অবশ্য তার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৫৬ সালের হিন্দু বিবাহ আইন অনুসারে এক স্ত্রী জীবিত থাকতে পুনরায় বিবাহ করা অপরাধ। আবার আর্থিক কারণে আজকাল তে অনেকে বিবাহই করছেন না। সারাজীবনই আইবুড়ে থেকে যাচ্ছেন।
মোটকথা, কিছুকাল আগে পর্যন্ত হিন্দুসমাজে বিবাহ ছিল সর্বজনীন ব্যাপার। এটা ছিল একটা ধর্মীয় সংস্কার এবং সকল হিন্দুকেই ওই সংস্কার অবশ্য পালন করতে হতো। তবে হিন্দুসমাজে বিবাহ নিজেদের স্ব স্ব নির্বাচনের উপর নির্ভর করতে না । পিতা-মাতা বা অভিভাবকরাই বিবাহ স্থির করতেন। এখনও অবশু এই নিয়মই বলবৎ আছে। তবে উদারপন্থী বাপ-মা আজকাল অনেক ক্ষেত্রে ছেলেকে স্বাধীনতা দিচ্ছেন আগে থাকতে মেয়েকে দেখে এসে পছন্দ করবার।
আজকালকার দিনে অনেক ক্ষেত্রে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন মারফত পাত্র ও পাত্রীপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে । কিন্তু আগেকার দিনে মধ্যস্থতা করবার জন্য ঘটকের সাহায্য নেওয়া হতো। বৈদিকযুগে এদের দিবিস্তু বা শম্ভাল বলা হতো। পরবর্তীকালে তারা ঘটক নামে পরিচিত হয়েছিল। এর জন্য ঘটকদের প্রতি পরিবারের কুলপঞ্জী রাখতে হতো। কুলপঞ্জীগুলোয় থাকতে পাত্রপাত্রী ও তাদের পূর্বপুরুষদের বংশতালিকা। কুলপঞ্জীর বিশেষ করে প্রয়োজন হতো, বিবাহে নিষিদ্ধ সপিণ্ড পরিহার করবার জন্য।
ঘটকরা সাধারণতঃ কোন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে পাত্রের পিতা কিংবা কোন জ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের নিকট উপস্থিত হতেন। যদি পাত্রপক্ষ প্রস্তাবিত সম্বন্ধ মঞ্জুর করতেন তা হলে যোটকবিচারের জন্য পাত্রীর ঠিকুজি চেয়ে পাঠানো হতো।
হিন্দুসমাজে মাত্র জাতি, শাখা, গোত্র প্রবর ও সপিণ্ডই যে অবাধ বিবাহের অন্তরায় হিসাবে কাজ করতো, তা নয়। এ সম্পর্কে জ্যোতিষের প্রভাবও কম ছিল না। হিন্দু কর্মবাদী, সে অদৃষ্টে বিশ্বাস রাখে এবং সেই কারণে জ্যোতিষের উপরও তার আস্থা খুব কম ছিল না। বিবাহ সম্পর্কে যোটকবিচারই জ্যোতিষের প্রধান অঙ্গ । বর ও কন্যার জন্মরাশি থেকে যে শুভাশুভ বিচার করা হয় তাকে যোটকবিচার বলা হয়। যোটকবিচার আট রকমের। বর্ণকুট, বগুকুট, তারাকুট, যোনিকুট, গণকুট, গ্রহমৈত্রীকুট, রাশিকুট ও ত্রিনাড়ীকুট। প্রতি কুটের গুণানুযায়ী তার মূল্যায়ন করা হয় এক একটি সংখ্যা দিয়ে। নাড়ীকুটের ৮, রাশিকুটের ৭, গণমৈত্রীকুটের ৬, যোনিকুটের ৪, তারাকুটের ৩, বগুকুটের ২, বর্ণ ও কুটের ১, মোট ৩৬ গুণ। সবরকম কুটের সমষ্টি অর্ধেকের বেশী হলে গুণাধিক্যহেতু বিবাহে মিলন শুভ হয় নতুবা অশুভতাহেতু সে পাত্রী পরিত্যক্ত হয়।
বিবাহের জন্য ভারতের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন মাস ব্যবস্থিত আছে। বঙ্গদেশে বিবাহের জন্য বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন মাস প্রশস্ত। বিবাহ পঞ্জিকার সব বৎসরেই হয়। কেবল গুজরাটে বিবাহ সব বৎসরে হয় না। সেখানে মাত্র বিশেষ বৎসরে বিবাহ হয় এবং এই বিশেষ বৎসর বহু বৎসরের ব্যবধানে আসে। সেই কারণে ওইরূপ সময় গুজরাটে বিবাহের মরসুম লেগে যায়। তখন সকলেই বয়স নির্বিশেষে ছেলেমেয়ের বিবাহ দেবার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এমন কি, পাছে গর্ভস্থ পুত্রকন্যার বিবাহ পরে ফসকে যায় সেই কারণে গর্ভবতী মেয়েরাও গর্ভস্থ পুত্রকন্যার পক্ষ হয়ে নিজেরাই বিবাহের সমস্ত আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এর ফলে অনেক অনুচিত ও অশোভনীয় বিবাহ হয়। যেমন বৃদ্ধের সহিত শিশুকন্যার বা বৃদ্ধার সহিত শিশুপুত্রের বিবাহ। এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণতঃ ওই শিশুপুত্র বা শিশুকন্য। যখন বিবাহের প্রকৃত বয়স প্রাপ্ত হয় তখন প্রথম বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সে বিনা অনুষ্ঠানে ও পুরোহিতের সাহায্য ব্যতিরেকে নূতন করে বিবাহ করতে পারে। এরূপ বিবাহকে “নানতারা” বলা হয়।
পাত্রী যদি কোষ্ঠী-ঠিকুজির ফঁাড়া কাটিয়ে উঠতে পারে তা হলে অভিভাবকরা পাত্রের অভিভাবকদের সঙ্গে বিবাহের কথাবার্তায় প্রবৃত্ত হয়। এই কথাবার্তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিবাহের বরপণ নির্ণয় করা। তবে পাত্রপক্ষ যদি আগে থাকতেই আভাস পায় যে, কন্যাপক্ষ তাদের মনোমত পণ দিতে অক্ষম, তা হলে কন্যাপক্ষকে সাফ জবাব দিয়ে দেয় যে কোষ্ঠীর মিল নেই। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা বরের জন্য পণ চায় আর নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা পণ চায় কন্যার জন্য। বরের পণের কোন সীমা নেই। কিন্তু মেয়ের পণের জন্য সাধারণত ১০০ থেকে ৫০০ টাকা চাওয়া হয়। উত্তর ভারতের সর্বত্রই নিম্নশ্রেণীর হিন্দুর পণ ব্যতিরেকে কখনও মেয়ের বিয়ে দেয় না। মেয়ের কি মূল্য হবে সেটা সাধারণতঃ মেয়ের বয়সের উপর নির্ভর করে। মেয়ের বয়স যত কম হয়, কন্যাপণ তত কম হয়। আবার কুমারীর ক্ষেত্রে কন্যাপণ বেশী, বিধবার পক্ষে কম। বরপণের ক্ষেত্রে বরের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ও বরের শিক্ষা-দীক্ষা ও উপার্জনশীলতার উপর এর তারতম্য নির্ভর করে। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বরপণ প্রথা নিম্নশ্রেণীর জাতিসমূহের মধ্যেও সংক্রামিত হচ্ছে। এর কারণ তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও উচ্চবর্ণকে অনুকরণ । দুষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে বিহারের যাদব মহাতোদের মধ্যে কন্যাপণ নেওয়াই প্রথাগত রীতি। কিন্তু বর্তমানে যে স্থলে বর লেখাপড়া শিখেছে সে স্থলে কন্যাপণের পরিবর্তে বরপণ চাওয়া হচ্ছে। অর্থনীতির যোগান-চাহিদা বিধি যে বিবাহ ক্ষেত্রেও”কার্যকরী, এটা তারই প্রমাণ ।