বাংলাদেশের নিম্নশ্রেণীর জাতিসমূহের মধ্যেও নানা শাখাউপশাখা পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, বাগদীরা নয়টি শাখায় বিভক্ত। এই শাখাগুলি হচ্ছে তেঁতুলিয়া, কাসাইকুলিয়া, ডুলিয়া, ওঝা, মেছুয়া, গুলি মাঝি, দণ্ড মাঝি, কুসমেতিয়া ও মল্লমেতিয়া (মাতিয়া বা মাতিয়াল ) । এই শাখাগুলি সবই অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কার্য করে। প্রতি শাখার মধ্যে অনেকগুলি করে উপশাখা আছে। সেগুলি বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। বাউরিদের মধ্যেও নয়টি শাখা আছে। যেমন, মল্লভুমিয়া, শিখরিয়া বা গোবরিয়া, পঞ্চকোটি, মোলা বা মুল, ধুলিয়া বা ধুলো, মলুয়া, ঝাটিয়া বা ঝেটিয়া, কাঠুরিয়া ও পাথুরিয়া। তবে বাগদীদের সঙ্গে বাউরিদের প্রভেদ এই যে, বাউরিদের মধ্যে এই সকল শাখা অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহ এই উভয় হিসাবেই কার্যকর । তাদের মধ্যে এ সম্বন্ধে কোন বাধাধরা নিয়ম নেই।
বিবাহ সম্পর্কে দক্ষিণ ভারতেও শ্রেণীগত অনেক বাধা আছে। তামিলনাড়র ব্রাহ্মণরা ধর্মগত সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত। আয়াররা শৈবভক্ত ও আয়াঙ্গাররা বিষ্ণুভক্ত। এর প্রত্যেকটি সেখানে অস্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করে। আবার কোন কোন জায়গায় এই উভয় শ্রেণীর তামিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহে আঞ্চলিক বাধাও আছে। এই সকল আঞ্চলিক বাধার মূল ভিত্তি হচ্ছে, স্ত্রী-পুরুষকে নিজ নিজ অঞ্চলে বা গ্রামে বিবাহ করতে হবে। যদিও বর্তমানে এই বিধি অনেক পরিমাণে শ্লথ হয়েছে, তথাপি দুই তিন পুরুষ আগে পর্যন্ত এ বিবাহ বিশেষ কঠোরতার সঙ্গে পালিত হতো।
কিন্তু হিন্দুসমাজে অবাধ বিবাহের আরও প্রতিবন্ধকতা আছে । উপরে যে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠীগুলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে অবাধ বিবাহ নিয়মিত হয় গোত্রপ্রবর ও সপিণ্ডবিধি দ্বারা । স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ কখনও সগোত্রে বা সমপ্রবরে হয় না। আবার সপিণ্ডের সহিতও বিবাহ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অংশে আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। তাদের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে গাএী, পর্যায়, শাখা, বেদ ও মাতা। তবে সপিণ্ডবিধিই হচ্ছে প্রধানতম অন্তরায়। এ সকল বাধা নিষেধের ফলে বিবাহের গণ্ডী এমনভাবে সংকীর্ণ হয়েছে যে, এ সম্পর্কে গণনা করে দেখা গিয়েছে যে উত্তর ভাবতে মাত্র সপিণ্ডবিধির নিষেধ মানতে গেলে ২,১২১টি আত্মীয়কে বিবাহের জন্য পরিহার করতে হয়। এ কারণে সপিণ্ডবিধিকে এখন তিনপুরুষের মধ্যে নিবদ্ধ করা হয়েছে। আবার যেখানে কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত অাছে সেখানে বিবাহের গণ্ডী মেল বন্ধন, থাক ও পটটি বন্ধন দ্বারা আরও সীমিত হয়ে গেছে।
দক্ষিণ ভারতে বাঞ্ছনীয় বিবাহ প্রচলিত থাকার দরুন, সপিণ্ডবিধি অনেক পরিমাণে শিথিল হয়ে গেছে। বাঞ্ছনীয় বিবাহ সাধারণতঃ মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বা মামাতো বোন কিংবা পিসতুতো বোনের সঙ্গে হয় । তবে যেখানে মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে সেখানে এরূপ বিবাহ সম্বন্ধে একটা বিশেষ বিধি-নিষেধ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বিবাহ মাত্র বড় বোনের মেয়ের সঙ্গেই হয়, ছোট বোনের মেয়ের সঙ্গে হয় না। মারাঠাদেশে এরূপ বিবাহ মাত্র পিতৃকেন্দ্রিক জাতিসমূহের মধ্যেই দেখা যায়, মাতৃকেন্দ্রিক জাতিসমূহের মধ্যে এটা নিষিদ্ধ।
ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ মাত্র পিসতুতো বোন বা মামাতো বোনের সঙ্গেই হয়। তার মানে, এক ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে আর অপর ক্ষেত্রে বিবাহ হয় মামাতো বোনের সঙ্গে । মাসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহ যদিও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে সাধারণ ভাবে নিষিদ্ধ তথাপি এর প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় অন্ধ্রপ্রদেশের কোমতি ও কুরুব জাতিদ্বয়ের মধ্যে। কর্ণাটকের কোন কোন জাতির মধ্যেও এর প্রচলন আছে। কর্ণাটক দেশে দশস্থ ব্রাহ্মণরাও ভাগ্নী ও মামাতো বোনকে বিবাহ করে।
যদিও উত্তর ভারতে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ সাধারণভাবে প্রচলিত নেই তথাপি অনুমান করা যেতে পারে যে এক সময় এর ব্যাপকতা ছিল। আমরা আগেই বলেছি যে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এর বহু উল্লেখ আছে। বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, কাথিয়াবার, মহারাষ্ট্র ও ওড়িষ্যার কোন কোন জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। রাজপুতদের মধ্যে মামাতে বোনের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক না হলেও এরূপ বিবাহ প্রায়ই সংঘটিত হতে দেখা যায়। রাজস্থান, কাথিয়াবাব ও গুজরাটের রাজন্তবর্গের মধ্যে এরূপ বিবাহের অনেক নিদর্শন আছে। যোধপুরের রাজপরিবারে পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের দৃষ্টান্তও আছে, মামাতো বোনের সঙ্গে নেই। তার মানে, মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ এক্ষেত্রে অনুমোদিত নয়। কিন্তু কাথি, আহির ও গাধব চারণদের মধ্যে মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহের কোন বাধা নেই! মহারাষ্ট্রের কুনবীদের মধ্যে কোন কোন শাখা ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ অনুমোদন করে কিন্তু অপর কতিপয় শাখা তা করে না । মধ্যমহারাষ্ট্রের মারাঠাদের মধ্যে কোন কোন সম্প্রদায়ের লোক মাত্র মামাতো বোনের সঙ্গে বিবাহ অনুমোদন করে কিন্তু ওর দক্ষিণে অবস্থিত লোকের মামাতো ও পিসতুতো উভয় শ্রেণীর বোনের সঙ্গেই বিবাহ মঞ্জুর করে ।
উত্তর প্রদেশের টেরি গাড়ওয়ালের ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহের একটা বৈচিত্র্য আছে। টেরি গাড়ওয়ালের ব্রাহ্মণরা দুটি শাখায় বিভক্ত—বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ও মিশ্র ব্রাহ্মণ। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণরা আর্যত্ব দাবী কবে আর মিশ্র ব্রাহ্মণরা উদ্ভূত হয়েছে বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ ও খস জাতির সংমিশ্রণে। এই কারণে মিশ্র ব্রাহ্মণদের খস ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত করা হয়। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণবা তুই উপশাখায় বিভক্ত— সরোলা ও যারা সরোলা নয়। শ্রেণী হিসাবে সরোলা সম্প্রদায় অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। কিন্তু সম্প্রদায় হিসাবে এরা এত ক্ষুদ্র যে বিবাহের জন্য এদের পাত্রী সংগ্রহ করা খুব মুশকিল হয়। এই কারণে সরোলা ব্রাহ্মণরা প্রায়ই খস জাতির মেয়ে বিবাহ করে। এছাড়া সবোলা ব্রাহ্মণরা অনেক সময় বাধ্য হয় যারা সরোলা নয় তাদের মেয়েকে বিয়ে কবতে। এখানে মজাব ব্যাপার হচ্ছে এই যে, একাপ বিবাহের পর সবোলা ব্রাহ্মণের মর্যাদাচু্যতি ঘটে না কিন্তু এই বিবাহেব ফলে যে সন্তান উৎপন্ন হয় সে তার পিতার মর্যাদা পায় না। তাকে বলা হয় গাঙ্গেরি ।