২। জাতি নির্বিশেষে সকলকেই পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহ অবশুই করতে হবে।
৩। কস্তার বিবাহ দিতে হবে সে ঋতুমতী হবার পূর্বে।
৪ । বিবাহ সংঘটিত হবে মাত্র জাতির মধ্যে ।
৫ । বিবাহ সগোত্রে, সপ্রবরে ও সপিণ্ডের মধ্যে হতে পারবে না।
৬। বিবাহিত নারীকে সতীত্বের সমস্ত বিধান অনুসরণ করে পতিব্ৰতা হয়ে থাকতে হবে ।
৭। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাকে সধবার সমস্ত ভূষণ পরিহার করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে ।
৮ । পরস্ত্রীগমন ব্যভিচাব বলে গণ্য হবে এবং তার জন্ম ব্যভিচারীকে গুরুদণ্ড পেতে হবে ।
বলাবাহুল্য, উত্তরকালের নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের যৌনজীবন এই সকল বিধির উপব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
০৪. জ্ঞাতিত্ব ও স্বজন বিবাহ
আমরা আগের অধ্যায়েই দেখেছি যে প্রাচীন ভারতে নানারকম বিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র একরকম বিবাহই আদর্শ বিবাহ হিসাবে নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে গৃহীত হয়েছিল। এই বিবাহ নিম্পন্ন হতো মন্ত্র উচ্চারণ, হোমাদি যজ্ঞ কৰ্ম সম্পাদন ও সপ্তপদীগমন দ্বারা । উত্তরকালে হিন্দুসমাজে এরূপ বিবাহই একমাত্র বৈধবিবাহরূপে গণ্য হয়েছিল। আমরা আরও দেখেছি যে, এরূপ বিবাহে কতকগুলি জ্ঞাতিত্বমূলক বিধি পালন করা হতো।
ভারতের জ্ঞাতিত্বমূলক সংগঠন দ্বিপার্থিক। পিতা এবং মাতা, এই উভয়েরই কুল বা বংশ অবলম্বন কবে জ্ঞাতিসমূহ নির্ধারিত হয়। এই উভয়কুলেই উধ্বতন প্রত্যেক জ্ঞাতিরই ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞ আছে। তবে বিবাহ সম্পর্কে এই সকল জ্ঞাতিবর্গের পদমর্যাদা ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের। উত্তর ভারতে পিতৃকুলেব উধ্বতন সাতপুরুষের এবং মাতৃকুলের উধ্বতন পাচপুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। এই নিষেধবিধিকে সপিণ্ডবিধি বলা হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ও পশ্চিম ভারতে অনেক স্থানে সপিণ্ডবিধির শ্লথতা দেখা যায়। এ সকল জায়গায় মামাতো বোন ও পিসতুতো বোন বাঞ্ছনীয় পাত্ৰী হিসাবে পরিগণিত হয়। দক্ষিণ ভারতে তামিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে মামার সঙ্গে ভাগ্নীর বিবাহও প্রচলিত আছে । সুতরাং বিবাহ সম্পর্কে সপিণ্ড বিধি দক্ষিণ ভারতে পূর্ণভাবে পালিত হয় না। তবে সহোদরা বা পিতৃকন্তর সঙ্গে বিবাহ হিন্দুসমাজে কোন জায়গাতেই হয় না।
বাঞ্ছনীয় বিবাহ যে মাত্র মাতুলকন্যা বা পিতৃম্বসার কন্যার মধ্যেই নিবদ্ধ, তা নয়। অপর শ্রেণীর জ্ঞাতিদের সঙ্গেও কোথাও কোথাও বিবাহের প্রচলন আছে। দেবরণ বা দেবর কর্তৃক বিধবা ভাবীকে বিবাহ এর অন্যতম । বর্তমানে এরূপ বিবাহ যদিও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, তবুও কালান্তরে যে এরূপ বিবাহ ভারতে ব্যাপক ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানে দেবরণ মাত্র উত্তর ভারতের কতিপয় জাতির মধ্যে ও বাংলা-ওড়িষ্যার নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত আছে। বর্তমানে যে ক্ষেত্রে দেবরণ প্রথা প্রচলিত আছে, সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা বিনা অনুষ্ঠানে দেবরের গৃহে গিয়ে কনিষ্ঠ ভ্রাতৃজায়ার সহিত সপত্নীরূপে বসবাস করতে সুরু করে। উত্তর ভারতে এরূপ রীতির নাম হচ্ছে “ঘর বঠেলি ।” তবে একথা বলা উচিত যে, উত্তর ভারতে বহুজাতির মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত থাকলেও উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজে এব কোন চলন নেই। ১৯২৯ সালে “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া” পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বর্তমান লেখক দেখিয়েছিলেন যে, বাঙালী সমাজে জ্ঞাতিত্বমূলক এমন অনেক আচার ব্যবহার আছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বাঙ্গালী সমাজেও এক সময় দেবরণ ও শু্যালিকাবরণ প্রচলিত ছিল । বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দুসমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে এরূপ রীতি প্রচলিত না থাকলেও বাউরি, বাগদি ও সাওতাল সমাজে এর প্রচলন আছে। ওড়িষ্যার নিম্ন শ্রেণীর জাতিসমূহও এই প্রথা অনুসরণ করে।
ভারতের কোন কোন জায়গায় এখনও বহুপতি গ্রহণ প্রথার প্রচলন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর সহোদর ভ্রাতারাই অন্তান্ত স্বামী হিসাবে কার্যকর থাকে। যে সমাজে ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিত্ব প্রচলিত আছে সে সমাজে একই স্ত্রীর উপর সকল ভ্রাতারই সমান যৌন অধিকার বিদ্যমান থাকে। যদিও বহুপতিত্ব আজ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মাত্র কয়েকটি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তথাপি এরূপ চিন্তা করবার যথেষ্ট অবকাশ ব্যাপকতা ছিল ।
দুটি বিশেষ ধরনের জ্ঞাতিত্বমূলক বিবাহ উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করে এবং লাখেব, বাগনি ও ডাফলা জাতির লোকেরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে
০৫. হিন্দুসমাজে বিবাহ
হিন্দুকে যে বিশেষ গণ্ডীর মধ্যে বিবাহ করতে হবে, সেটা স্থির হয়ে যায় তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে । কেননা হিন্দুসমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক হিন্দুকে তার নিজ জাতির মধ্যেই বিবাহ করতে হয়। এক কথায়, হিন্দুসমাজব্যবস্থায় জাতিই হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠীস্বরূপ । তবে, নিজ জাতির মধ্যে যে কোন পুরুষ যে কোন স্ত্রীলোককে অবাধে বিবাহ করতে পারে না। জাতিসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই শাখা ও উপশাখায় বিভক্ত এবং এই শাখা-উপশাখাগুলি আবার বিবাহের গণ্ডী নির্ধারণ করে দেয় । যেমন, উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণগণ আটটি শাখায় বিভক্ত। পঞ্চগৌড়, পঞ্চদ্রবিড় সারস্বত, পুষ্করণ, শ্রীমালী, ছন্ততি, শাকদ্বীপী ও উদীচ্য। এগুলি প্রত্যেকেই অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করে। তার মানে, এক শাখার স্ত্রী-পুরুষের বিবাহ অন্য শাখাব স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বিবাহের গোষ্ঠীগুলিকে আরও সংকীর্ণ করা হয়েছে শাখাগুলিকে উপশাখায বিভক্ত করে। যেমন, উত্তব ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে ছন্ততি শাখা ছয়টি উ য় বিভক্ত। যথা, সারস্বত, গুর্জরগড়, খাণ্ডেলবাল, দধীচ, শিকওয়াল ও পারিখ । এর প্রত্যেকটিই অন্তর্বিবাহকারী উপদল । অনুরূপভাবে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণরা প্রধানতঃ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত—রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বৈদিক। বৈদিকরা আবার তুই শ্রেণীতে বিভক্ত—পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য । এ ছাড়া বাংলাদেশে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণও আছে। এগুলি সবই অন্তর্বিবাহকারী গোষ্ঠী। বাংলাদেশের কায়স্থদের মধ্যেও তিন শ্রেণী আছে, রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ। রাঢ়ীরা আবার দুই শ্রেণীতে বিভক্ত—উত্তর রাঢ়ী ও দক্ষিণ রাঢ়ী। সদ্বগোপদের মধ্যেও অনুরূপভাবে দুই বিভাগ আছে। পূর্বকুল ও পশ্চিমকুল। বলাবাহুল্য কিছুকাল আগে পর্যন্ত উপরোক্ত শ্রেণীসমূহ সবই অস্তবিবাহের গোষ্ঠী হিসাবে কার্যকর ছিল। তার মানে এক শ্রেণীর সহিত অপর শ্রেণীর কোন বৈবাহিক আদানপ্রদান ঘটতো না। তবে বর্তমানে গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাবে এ সকল নিষেধমূলক বাধা ক্রমশঃ শিথিল হয়ে যাচ্ছে।