উত্তরকালের হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে বিবাহিত নারীর পুনরায় বিবাহ অবশ্য সহনীয় রীতি ছিল। না। এমন কি স্বামী নিরুদিষ্ট হলেও নারীকে শাস্ত্রনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে, সধবা স্ত্রীলোকের সমস্ত চিহ্ন পরিহার করে বিধবার ভূষণ গ্রহণ করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হতো। মনে হয় যে, উত্তরকালে নারীর সতীত্ব সম্বন্ধে যে নুতন ধ্যান গৃহীত হয়েছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় এই পরিবর্তন ঘটেছিল।
“নিয়োগ” প্রথানুযায়ী অপর পুরুষের দ্বারা গর্ভসঞ্চারণ করানোর রীতি যখন বিলুপ্ত হলো, তখন নারীর সতীত্ব সম্পর্কে হিন্দুসমাজে এক নূতন ধারণা কল্পিত হলো। চরিত্রবর্তী সতী নারী পতিব্ৰতারূপে পরিগণিত হলো। পতিব্ৰতা নারী বলতে বুঝালে৷ সেই স্ত্রীকে যে মনেপ্রাণে স্বামীর প্রতি অনুরক্ত এবং শয়নে-স্বপনে ও সকল কর্মে স্বামীর অনুবর্তিনী। স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সহিত যৌনসংস্রব ব্যভিচার বলে পরিগণিত হলো। নিজ স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন নারীর সহিত যৌনসংস্রব পুরুষের পক্ষেও নিষিদ্ধ হলো। মনু নূতন সামাজিক চিন্তার স্রষ্টা হয়ে দাড়ালেন। মনু বিধান দিলেন, “পরদার গমনের তুল্য পাপ ইহজগতে এমন কিছু নেই যা মানুষকে স্বল্পায়ু করে তোলে। স্ত্রীলোকের গাত্রে যত লোমকূপ বা রন্ধ আছে, পরদারগামী পুরুষকে তত বৎসর নরকে বাস করতে হয়।” পরদার গমন অপরাধের জন্য স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণসমূহে অতি কঠোর শাস্তি ব্যবস্থিত হলো। বৌধায়ন ও মনু উভয়েই ব্যভিচারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা করলেন। আপস্তম্ভ বললেন যে, ব্যভিচার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ কর্তন করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং যদি সে কোন অনুঢ়া কন্যার সঙ্গে ব্যভিচার করে থাকে তাহলে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হবে। আরও বলা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট নারী বা কুমারীকে রাজা সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করবেন এবং তার অভিভাবকদের হাতে তাকে প্রত্যপণ করবেন, যদি অভিভাবক তার দ্বারা যথোচিত প্রায়শ্চিত্ত নিম্পাদনের ব্যবস্থা করেন। ব্যভিচারীর শাস্তিস্বরূপ নারদ যে দণ্ড বিধান করেছেন তা হচ্ছে, ১০০ পণ অর্থদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, পুরুষাঙ্গছেদন ও মৃত্যু। মোটকথা, সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই ব্যভিচার অপরাধের জন্য নানারূপ কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি নিজ স্ত্রীকে অপরের সহিত আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দেখে এবং রোষাম্বিত হয়ে উভয়কেই হত্যা করে, তবে তার জন্য সে কোন দণ্ড পাবে না ।
একথা এখানে বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে স্মৃতিশাস্ত্র সমূহের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যভিচার মাত্র যৌনসঙ্গমের দ্বারাই সংঘটিত হতো না। কেননা শাস্ত্রানুযায়ী মৈথুন আট প্রকাবে নিম্পন্ন হয়। স্মরণ, কীর্তন, কেলি, প্রেক্ষণ, গৃহভাষণ, সঙ্কল্প, অধ্যবসায় ও ক্রিয়ানিস্পত্তি দ্বারা। শাস্ত্রকাররা বলেছেন যে, যদি কাহাকেও অপরের স্ত্রীর সঙ্গে নদীর সঙ্গমস্থলে, কী স্বানের ঘাটে, কী উদ্যানে, কী অরণ্যে বাক্যালাপ করতে দেখা যায় বা তার সঙ্গে বিহার করতে দেখা যায় বা তাকে চুম্বন করতে দেখা যায় বা তার প্রতি চক্ষুদ্বারা ইঙ্গিত করতে বা হাস্য করতে দেখা যায় বা তার বস্ত্র বা আভরণ অনুচিতস্থানে স্পর্শ করতে দেখা যায় বা তার সঙ্গে একই শয্যায় উপবিষ্ট থাকতে দেখা
যায় বা তার হস্ত, কেশ বা বস্ত্রপ্রান্ত ধরতে দেখা যায়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচার অপরাধে লিপ্ত বলে গণ্য হবে। নারদ একথাও বলেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে গর্বসহকারে বলে যে, সে অমুক স্ত্রীলোককে সম্ভোগ করেছে, তাহলে শাস্ত্রানুযায়ী সেও ব্যভিচার দোষে লিপ্ত ।
যতপ্রকার ব্যভিচার আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত ও কদৰ্য বলে শাস্ত্রে নিন্দিত হয়েছে, গুরুতল্প বা গুরুস্ত্রীগমন। গুরুস্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংস্রবের জন্য শাস্ত্রে অতি কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনু বলেছেন, যে ব্যক্তি গুরুতল্প অপরাধে অভিযুক্ত, তাকে জলন্ত লৌহকটাহের উপর উপবিষ্ট করাতে হবে, তার পুরুষাঙ্গ কর্তন করতে হবে এবং তার দুই চক্ষু উৎপাটিত করতে হবে।
সতীত্ব সম্পর্কে নূতন ধারণার উদ্ভবের সঙ্গে বিধবার পক্ষে নিষ্কাম, নিষ্কলঙ্ক ও পবিত্র জীবনযাপন করবার উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হলো। পরাশর বললেন যে, বিধবা নিষ্কাম ও সতীত্বপূর্ণ জীবনযাপন করলে তার উচ্চতম স্বর্গে স্থান হবে। পরাশর আরও বললেন যে, বিধবা যদি বৈধব্য অবস্থায় গর্ভবতী হয়, তাহলে তাকে দেশ থেকে বহির্ভূত করে দেওয়া হবে।
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, স্মৃতিপুরাণ যুগের যৌনজীবনের ডামাডোলের ভেতর দিয়ে একটা সুস্থিত আদশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। বিভিন্ন স্মৃতিকারদের পরস্পরবিরোধী বিধানসমূহের মধ্যে একট। সমন্বয় আনবার চেষ্টা করেছিলেন মমু। পরবর্তীকালে মনুর বিধানই প্রাধান্ত লাভ করেছিল। র্তার বিধানের ভিত্তিতে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল সেই আদর্শ
রচিত হয়েছিল নিম্নলিখিত বিধিগুলি নিয়ে—
১। বিবাহ নিম্পন্ন হবে মাত্র মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ সম্পাদন ও সপ্তপদী গমনদ্বারা ।