আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, “সন্তান প্রজননের জন্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অপরের হস্তে সমর্পণ করা কলিযুগে নিষিদ্ধ হয়েছে। কলিযুগে এরূপ যৌনমিলন ব্যভিচাররূপে গণ্য হয় এবং এরজন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।” এই উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ববর্তীকালের সমাজে “নিয়োগ” প্রথা অনুমোদিত হলেও, পরবর্তীকালের সমাজে এ প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল। নিয়োগ প্রথার পিছনে যে যুক্তি ছিল তা হচ্ছে, “যেহেতু স্ত্রী স্বামীর পুত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রস্বরূপ, সেইহেতু ক্ষেত্রের মালিক হিসাবে তার অধিকার আছে ওই ক্ষেত্র নিজে বা অপরকে দিয়ে কৰ্ষিত করবার।” যাহোক, শাস্ত্রকারদের পরস্পর বিরোধী বিধানসমূহ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, প্রাক্তনকালের প্রথা পরবর্তীকালে অবৈধ এবং গৰ্হিত বলে ঘোষিত হয়েছিল। বস্তুতঃ একথা অনেক জায়গায় বলা হয়েছে যে, প্রাচীনকালে দেবতা ও ঋষিদের পক্ষে যা বৈধ এবং প্রশস্ত ছিল, পরবর্তীকালের মানুষের পক্ষে তা গৰ্হিত ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
“নিয়োগ” প্রথানুযায়ী প্রসূত সন্তানের পিতৃত্ব সম্পর্কে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “কোন অপুত্রক ব্যক্তি যদি অপর কোন অপুত্রক ব্যক্তির “ক্ষেত্রে” সন্তান উৎপাদন করে তাহলে উভয় অপুত্ৰক ব্যক্তিই সেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য হবে এবং সেই সন্তান উভয় ব্যক্তিরই শ্রাদ্ধ সম্পাদনের অধিকারী হবে।” পরাশর বলেছেন, “ক্ষেত্রের অধিকারীর ( স্বামীর ) অনুমতি পেয়ে কেহ যদি অধিকারীর ক্ষেত্রে বীজ বপন করে, তাহলে সেই উৎপন্ন ফলের অধিকারী উভয়েই, ‘ক্ষেত্র’ অধিকারী ও বীজ অধিকারী। তবে বীজ অধিকারী যদি ক্ষেত্র অধিকারীর গৃহে গিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়, তবে সেক্ষেত্রে বীজ অধিকারী সন্তানের মালিক নয়। শাস্ত্রকাররা এইরূপ মিলনকে ব্যভিচার বলে গণ্য করেছেন। আর স্ত্রী যদি বীজ অধিকারীর গৃহে তার সঙ্গে মিলিত হয়, তবেই বীজ অধিকারী সেই উৎপন্ন সন্তানের অধিকারী হয়।” কৌটিল্যও বলেছেন যে, স্ত্রী যদি স্বামী গৃহেই অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করান, তাহলে স্বামীই উৎপন্ন সন্তানের মালিক। বীজ আধিকারীর সন্তানের উপর অধিকার, মাত্র তখনই অর্সায় যখন স্ত্রী বীজ অধিকারীর গৃহে গিয়ে সস্তান উৎপাদন করান ।
নারীর পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে স্মৃতিকাররা কতকগুলি কৌতুহলোদ্দীপক কথা ৰলেছেন। এ সম্বন্ধে সাধারণ বিধি ছিল এই যে, কন্যাকে মাত্র একবারই সম্প্রদান করা যেতে পারে। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “অধিকতর গুণবিশিষ্ট পাত্র পাওয়া গেলে দত্ত কন্যাকে আবার দ্বিতীয় বার দান করা যেতে পারে।” নারদও বলেছেন, “অনুঢ়া কন্যাকে দান করবার জন্য যদি একবার মূল্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং পরে যদি অধিকতর গুণবিশিষ্ট পাত্র পাওয়া যায় তাহলে পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যেতে পারে।” নারদ আরও বলেছেন, “কন্যাকে মাত্র একবারই দান করা চলে”–এই বিধি মাত্র ব্রাহ্ম, আর্শ, দৈব, প্রাজাপত্য ও গান্ধৰ্ববিবাহের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত, অন্য ক্ষেত্রে এটা পাত্রের গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। মনু বলেছেন, “যদি বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার পূর্বেই পাত্র মারা যায়, তাহলে কন্যাকে পাত্রের ভ্রাতার হস্তে দান করা যেতে পারে।” তবে বশিষ্ঠ ও বৌধায়ন উভয়েই বলেছেন, “যে ক্ষেত্রে কন্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহে দান করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও কন্যার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেওয়া চলে।” এ-কথারই প্রতিধ্বনি করে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, শিবের বিধান অনুযায়ী কন্যার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেওয়া চলে। অত্যয় অবস্থাতেও নারীর দ্বিতীয়বার বিবাহ স্মৃতিকাররা অনুমোদন করেছেন। স্বামী যদি বিদেশ ভ্রমণে যান এবং শাস্ত্রনির্দিষ্টকালের মধ্যে প্রত্যাগমন না করেন, তাহলে স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে। নির্দিষ্ট কি সময় উত্তীর্ণ হলে স্ত্রী আবার দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারে, সে সম্বন্ধে নারদ বলেছেন,“সন্তানবতী ব্রাহ্মণবর্ণেব নারীকে আট বৎসর অপেক্ষা করতে হবে আর সন্তানহীনা নারীকে চার বৎসর। অনুরূপভাবে ক্ষত্রিয়া নারীকে যথাক্রমে ছয় বৎসর ও তিন বৎসর, বৈশ্রাণ নারীকে চার বৎসর ও দুই বৎসর অপেক্ষা করতে হবে। শূদ্র নারীর পক্ষে কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, যে কোন সময় সে পুনরায় বিবাহ করতে পারে।” বশিষ্ঠ বলেন যে, এরূপ বিবাহ নিজবংশেরই অন্ত কোন ব্যক্তির সঙ্গে হওয়া চাই। বশিষ্ঠ এ সম্পর্কে যে সময় অতিবাহনের নির্দেশ দিয়েছেন, তা হচ্ছে ব্রাহ্মণীর পক্ষে সাড়ে পাচ ও চার বৎসর, ক্ষত্রিয়ার পক্ষে পাচ ও তিন বৎসর, বৈষ্ঠার পক্ষে চার ও দুই বৎসর এবং শূদ্রার পক্ষে তিন ও এক বৎসর। মনু এ সম্বন্ধে জাতিনির্বিশেষে বিধান দিয়েছেন যে, স্বামী যদি তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে বিদেশে যান, তাহলে স্ত্রীকে আট বৎসর অপেক্ষা করতে হবে আর যদি যশার্জনের জন্য যান তাহলে ছয় বৎসর এবং যদি মৃগয়া বা প্রমোদের জন্য যান তাহলে তিন বৎসর অপেক্ষা করতে হবে ।
সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণে একথা অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত হয়েছে যে, স্বামী যদি মৃত কী নিরুদ্দিষ্ট হন, কী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, কী নপুংসক প্রতিপন্ন হন, কী সমাজে পতিত হন, তাহলে এই পাচ প্রকার অত্যয়কালে স্ত্রী পুনরায় স্বামী গ্রহণ করতে পারেন। আরও বলা হয়েছে যে, কোন নিষ্কলঙ্কা কন্যা যদি ভুলক্রমে কোন চিরব্যাধিগ্রস্ত, কী কুৎসিত ব্যাধিগ্রস্ত, কী বিকলাঙ্গ, কী গৃহহীন, কী জাতিভ্রষ্ট বা জ্ঞাতিকুটুম্ব পরিত্যক্ত, কী দারিদ্র্যক্লিষ্ট ব্যক্তির সহিত বিবাহিত হয়, তবে সে স্বামীকে পরিত্যাগ করে পুনরায় বিবাহ করতে পারে।