“প্রবর” বলতে প্রাচীন পূর্বপুরুষ ঋষিগণের নামের তালিকা বোঝায়। আসলে এগুলি গোত্রের মধ্যে ছোট ছোট পরিবারের নাম। এগুলি গোত্র-প্রবর্তক ঋষিদের পুত্র-পৌত্রদের নামানুসারে চিহ্নিত। প্রত্যেক প্রবরে এক, দুই, তিন বা পাচজন ঋষির নাম দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি গোত্রের সঙ্গে ওই গোত্র সংশ্লিষ্ট প্রবর নামগুলিও কীর্তিত হয়ে থাকে। যদি তুই গোত্রপ্রবরে একই ঋষির নাম থাকে তাহলে গোত্র ত্বটির অভিন্নতা প্রতিপন্ন হয়। এরূপ সমানপ্রবরবিশিষ্ট গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
স্মৃতির যুগে, গোত্রপ্রবর ছাড়া হিন্দুদের মধ্যে অবাধ বিবাহের আর এক প্রতিবন্ধকতার স্থষ্টি হয়েছিল। সেটা হচ্ছে সপিণ্ড বিধি। আগেই বলা হয়েছে যে সপিণ্ড বলতে পিতৃকুলে উৰ্দ্ধতম পাচপুরুষের জ্ঞাতিবর্গকে বোঝায়। পিতৃকুলের সপিণ্ডগণকে “গোত্রজ সপিণ্ড” ও মাতৃকুলের সপিণ্ডগণকে “ভিন্নগোত্র সপিণ্ড” বা “বন্ধু” বলা হয়। সপিণ্ডদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে উত্তর ভারতে সপিণ্ড বিবাহ নিষেধবিধি যেরূপ কঠোরতার সঙ্গে পালিত হয়, দক্ষিণ ভারতে তা হয় না। তার কারণ, দক্ষিণ ভারতে “বাঞ্ছনীয় বিবাহ”-এর প্রচলন আছে।
ভাই বোন সকলে কি অনুক্রমে বিবাহ করবে ! তার-ও একটা নির্দেশ স্মৃতিকাররা দিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, জ্যেষ্ঠ ভগিনীর বিবাহের পূর্বে কনিষ্ঠ ভগিনী যদি বিবাহ করে, তাহলে তা শাস্ত্র বিরুদ্ধ আচরণ হবে। এরূপ বিবাহ হলে বিবাহিত কনিষ্ঠা কন্যার স্বামী ও পরে বিবাহিত জ্যেষ্ঠ ভগিনীর স্বামী, এই উভয়কে জাতি থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হবে এবং তাদের কোন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগদান করতে দেওয়া হবে না। বশিষ্ঠ এ সম্পর্কে কৃচ্ছ, ও অতিকৃচ্ছ, এই দুই প্রকার প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এরূপ ক্ষেত্রে কনিষ্ঠার স্বামীকে বারদিন কৃচ্ছসাধন করতে হবে এবং কনিষ্ঠাকে জ্যেষ্ঠ কন্যার স্বামীর হাতে সমর্পণ করতে হবে এবং অনুরূপভাবে জ্যেষ্ঠ কন্যার স্বামীকে কৃচ্ছ_ ও অতিকৃচ্ছ, এই উভয়বিধ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এবং জ্যেষ্ঠা কন্যাকে কনিষ্ঠ কন্যার স্বামীর হাতে অৰ্পণ করতে হবে। তারপর তারা পরস্পর পরস্পরের স্ত্রীকে তাদের প্রকৃত স্বামীর হাতে আবার প্রত্যপণ করবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তারা পুনরায় বিবাহিত হবে। পরাশর অবশ্য বলেছেন যে, জ্যেষ্ঠ যদি জন্মাবধি কুজা, বামনাকৃতি, দুর্বলচিত্ত, অন্ধ, মুক বা বধির হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে কনিষ্ঠ বিনাদণ্ডে জ্যেষ্ঠার আগেই বিবাহ করতে পারবে।
নরক থেকে পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করবার জন্য পুত্র উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার উপর স্মৃতিকাররা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এই কারণে বিবাহিত জীবনে যদি সন্তান উৎপন্ন না হয়, কী নিঃসন্তান অবস্থায় যদি কেহ মারা যায়, তা হলে তার স্ত্রী বা বিধবার “ক্ষেত্রে” অপরের দ্বারা সন্তান উৎপাদনের বিধান স্মৃতিকাররা দিয়েছিলেন । এই ব্যবস্থাকে “নিয়োগ” প্রথা বলা হতো। “নিয়োগ” আর কিছুই নয়, স্বামীর পরিবর্ত হিসাবে কোন নিযুক্ত ব্যক্তিকে উৎপাদকরূপে গ্রহণ করা। শাস্ত্র অনুযায়ী মৃতব্যক্তির ভ্রাতা বা কোন নিকট আত্মীয়, বিশেষ করে সপিণ্ড বা সগোত্রকে নিযুক্ত করা হতো। “নিয়োগ” প্রথা অনুযায়ী মাত্র এক বা ফুটি সন্তান পর্যন্ত উৎপন্ন করা যেতো, তার অধিক নয়। মনু এবং গৌতম মাত্র দুটি সন্তান উৎপাদনেরই অনুমতি দিয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে কামবর্জিত হয়ে এবং অত্যন্ত শুচিপূর্ণ অন্তকরণে এই প্রথানুযায়ী সন্তান উৎপাদন করা হতো। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্তান প্রজননের সময় উভয়ে নিজ নিজ চিত্তবৃত্তিকে এমনভাবে উন্নীত করবে যে, পরস্পর পরস্পরকে শ্বশুর ও পুত্রবধুরূপে বিবেচনা করবে। এক কথায়, সন্তান প্রজননের সময় সকল প্রকার কামভাব পরিহারের উপর শাস্ত্রকাররা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ সম্বন্ধে বশিষ্ঠ বলেছেন যে, বিধবাকে প্রথম ছয়মাস কৃচ্ছসাধন করতে হবে, তারপর ঋতুকালে তাকে নিযুক্ত ব্যক্তির কাছে যেতে হবে। বৌধায়ন কিন্তু কৃচ্ছ সাধনের জন্য এক বৎসর সময়ের ব্যবস্থা করেছেন। যেহেতু নিজের স্ত্রী নয়, এরূপ স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান উৎপাদিত হচ্ছে, সেইহেতু এরূপ ভাবে উৎপন্ন সন্তানকে “ক্ষেত্ৰজ” সন্তান বলা হতো। স্মৃতিযুগের শেষের দিকে কিন্তু “নিয়োগ” প্রথা পরিত্যক্ত হয়েছিল। সেজন্ত দেখতে পাওয়া যায় যে, মনু যদিও তার ধর্মশাস্ত্রের এক অংশে এর অনুমোদন করেছেন, অপর অংশে কিন্তু তিনি এই প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে গর্হিত বলে ঘোষণা করেছেন। বৃহস্পতিও বলেছেন যে, কলিযুগে “নিয়োগ” প্রথা যথাযথ নয়।
যে অংশে মন্ত্র নিয়োগ প্রথার অনুমোদন করেছেন, সেখানে তিনি একথা পরিষ্কার ভাবেই বলেছেন, যে স্ত্রীলোকের কোন সন্তান হয় নি, মাত্র সেই স্ত্রীলোকই “নিয়োগ” প্রথা অবলম্বনের প্রকৃত অধিকারিণী। একথাও তিনি বলেছেন যে, নিঃসন্তান হলে স্বামীর
জীবদ্দশাতেই স্বামী কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে স্ত্রী “নিয়োগ” প্রথানুযায়ী সন্তান উৎপাদনের জন্য অপর পুরুষকে আহবান করতে পারেন। তবে
একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, এই উদ্দেশ্যে মাত্র কোন আত্মীয়কেই স্বাহবান করা যেতো, অপরকে নয়। স্বামীর জীবদ্দশাতেই নিয়োগপ্রথা অবলম্বনের অধিকার, স্ত্রীকে অন্যান্য স্মৃতিগ্রস্থ ও পুরাণেও দেওয়া হয়েছে। মহাভারতেও উক্ত হয়েছে যে, পাণ্ডু এই অধিকার কুন্তীকে দিয়েছিলেন।