ঋতুকালে স্বামী-স্ত্রীর মিলন সম্বন্ধে স্মৃতিকারগণ বিশেষ জোরের সঙ্গে বিধান দিলেও, ঋতুসঞ্চারের প্রথম চারদিনে মিলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। বলা হয়েছে যে, ঋতুসঞ্চারের প্রথম চারদিন নারী সঙ্গমের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে অনুপযুক্ত থাকে, ঐ সময় স্ত্রীতে উপগত হলে পুরুষকে পাপে লিপ্ত হতে হয় এবং সে ভবিষ্যতে সুখ, শান্তি ও আয়ু থেকে বঞ্চিত হয়। এই পাপকে গুরুতল্প ( গুরুপত্নীর সঙ্গে যৌন সংসৰ্গ ) পাপের সহিত তুলনা করা হয়েছে।
স্মৃতিগ্রন্থসমূহে আরও বলা হয়েছে যে, যেহেতু ঋতু সঞ্চারের প্রথম চারদিন নারী সম্পূর্ণ অশুদ্ধ থাকে, সেইহেতু এই সময় সে অপরের সামনে উপস্থিত হবে না, যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে দূরে থাকবে, তার দ্বারা স্পৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য অপরে গ্রহণ করবে না। যদি ওই সময় কেউ তাকে স্পর্শ করে তবে সে নিজেকে কলুষিত করবে আর ইচ্ছাপূর্বক যদি নারী নিজে কোন ব্রাহ্মণকে স্পর্শ করে, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে কষাঘাত করা হবে । বলা হয়েছে যে, স্থষ্টির প্রারম্ভে নারী রজস্বলা হতো না । সেজন্য সঙ্গম সত্ত্বেও নারীর গর্ভ হতো না। পরে যখন কামের জন্ম হয়, তখন সে রজস্বলা হতে সুরু করে এবং সঙ্গমের ফলে গর্ভধারণও করতে থাকে। তার আগে পর্যন্ত মানবসমাজে যোগসাহায্যে সন্তান উৎপাদন করা হতো। মহাভারতের একস্থানে ভীষ্মও বলেছেন “দেবতারা পাচ প্রকারে সন্তান উৎপাদন করেন, বাসনা দ্বারা, বাক্য দ্বারা, দর্শন দ্বারা, স্পর্শন দ্বারা ও যৌনসঙ্গম দ্বারা ।
যদিও স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ ও পুরাণের যুগে জাতিসমূহের মধ্যে সবর্ণ বিবাহই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ কর্তৃক শুদ্রকষ্ঠার পাণিগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত আছে। আগেই বলা হয়েছে যে, যেখানে উচ্চ বর্ণের পুরুষের সঙ্গে হীনবর্ণের মেয়ের বিবাহ হতো, সেরূপ বিবাহকে অমুলোম বিবাহ বলা হতো। আর যেখানে উচ্চ বর্ণের মেয়ের সঙ্গে হীনবর্ণের পুরুষের বিবাহ হতো, তাকে বলা হতে প্রতিলোম বিবাহ। অমুলোম বিবাহ বৈধ ছিল কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ নিন্দিত ছিল। এরূপ ব্যতিক্রম থাকলেও সবর্ণ বিবাহই সকল জাতির পক্ষে বিধিসম্মত বিবাহ ছিল ।
সবর্ণে বিবাহের বিধি ছাড়া, স্মৃতি ও পুরাণের যুগে বিবাহ নিয়ন্ত্রিত হতে আরম্ভ হয়েছিল গোত্রপ্রবর ও সপিণ্ড দ্বারা। একই গোত্রে বা প্রবরে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। মনে হয়, গোত্রবিধি প্রথম ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, পরে তা ক্ষত্রিয়গণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু “প্রবর” মাত্র ব্রাহ্মণদেরই ছিল, ক্ষত্রিয়দের ছিল না। ক্ষত্রিয়দের এর বদলে ছিল “কুল”। প্রাচীন ভারতে প্রবর ও কুল এই উভয়েরই বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কেন-না যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় নিজ প্রবর বা কুল ঘোষণা করতে পারতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করা হতো না। এই কারণেই আমরা মহাভারতের আদিপর্বে দেখতে পাই যে কৰ্ণ নিজকুল ঘোষণা করতে না পারায় অজুন তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে অসম্মত হয়েছিলেন। শতপথ ব্রাহ্মণে সত্যকাম জাবালির কাহিনী থেকেও এ প্রকাশ পায়। “গোত্র” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে “গো-বেষ্টনী” । কার্যক্ষেত্রে কিন্তু গোত্র বলতে, বংশের পূর্বপুরুষ ঋষির নাম বুঝাতে । মনে হয়, উত্তর ভারতে প্রথমে গোত্রপ্রেথা প্রচলিত ছিল না এবং পূর্ব বা দক্ষিণ ভারত থেকে এর প্রবর্তন হয়েছিল উত্তর ভারতে। শাস্ত্রানুসারে দক্ষিণ ভারতের ঋষি বৌধায়নই উত্তর ভারতে এর প্রচলন করেছিলেন। বৌধায়ন শ্রোতসূত্রে আটজন গোত্র-প্রবর্তক ঋষির নাম পাওয়া যায়। এই আটজনের নাম যথাক্রমে—ভরদ্বাজ, জমদগ্নি, গৌতম, অত্রি, বিশ্বামিত্র, বসিষ্ঠ ( বশিষ্ঠ ), কশ্যপ এবং অগস্ত্য । বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণরা সকলেই এই আটজন ঋষির মধ্যে কোন না কোন ঋষির সন্তান। যারা একই গোত্রের অন্তভুক্ত, তাদের বলা হয় সগোত্র। সগোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বর্হিবিবাহের একটা সুনির্দিষ্ট প্রণালী প্রতিষ্ঠার জন্যই বৌধায়ন গোত্রপ্রথার প্রচলন করেছিলেন । পরবর্তীকালে অবশ্য আরও অনেক গোত্র-প্রবর্তক ঋষির নাম পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বর্তমানে বঙ্গদেশে যে সকল গোত্র প্রচলিত আছে, সেগুলি যথাক্রমে—অত্রি, অগস্ত্য, অনাবৃকাক্ষ, অব্য, আত্ৰেয়, আংগিরস, আলম্ব্যায়ণ, কাঞ্চন, কাত্যায়ণ, কান্ধ, কাস্বায়ণ, কুষিক, কৌশিক, কৃষ্ণাত্রেয়, কাশ্যপ, গৌতম, গাৰ্গ, জৈমিনি, বশিষ্ঠ, বৈয়াস্ত্ৰপদ্য, বিশ্বামিত্র, বিষ্ণু,বাৎস্ত, বৃদ্ধি,স্কৃতকৌশিক, পরাশর, ভরদ্বাজ, মৌদগল্য, জমদগ্নি, রথিতরু, শাণ্ডিল্য, শকত্রি, শুনক, সাংকৃতি, সৌপায়ণ, জাতুকৰ্ণ, ক্ষেত্রি, মৈত্রায়ণি ও ধন্বন্তরি। আগেই বলা হয়েছে যে, গোত্র প্রথমে মাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বর্ণের, প্রকৃত পক্ষে কোন গোত্র ছিল না। পরবর্তীকালে র্তারা তাদের কুলপুরোহিতগণের গোত্রসমূহই গ্রহণ করেছিলেন ।
হিন্দুর বিবাহের উপর গোত্রবিধির প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেন-না সগোত্রে বিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ ব্যাপার। ১৯৪৬ সালে “হিন্দু বিবাহে অযোগ্যতা নিরোধক” আইন বিধিবদ্ধ হবার পূর্ব পর্যন্ত সগোত্রে বিবাহ অবৈধ বলেই বিবেচিত হতো। শাস্ত্রে এরূপ বিবাহকে অজাচার বলে বর্ণনা করা হয়েছে।