স্মৃতিকারদের দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবাহ ছিল ধর্মবিহিত কর্তব্য কর্ম বা সংস্কার। সকল ব্যক্তির পক্ষেই এই কর্তব্য পালন বাধ্যতামূলক ছিল, বিশেষ করে নরক থেকে পিতৃ-পুরুষদের উদ্ধারের নিমিত্ত পুত্র উৎপাদন করবার জন্য। যদিও মনুসংহিতায় আট রকম বিবাহেব উল্লেখ করা হয়েছে এবং আপস্তম্ভ ও বশিষ্ঠ ছয় রকম বিবাহের অনুমোদন করেছেন, তথাপি মাত্র সেই বিবাহকেই স্মৃতিশাস্ত্রের যুগে শাস্ত্রসম্মত বিবাহ বলে গণ্য কব হতো, যে বিবাহে মন্ত্র উচ্চারিত হতো, হোম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো ও সপ্তপদীগমণ অবলম্বিত হতো। এরূপ বিবাহকে শাস্ত্রে ব্রাহ্ম বিবাহ বলা হতো। এাহ্মণের পক্ষে এই বিবাহই প্রশস্ত বিবাহ ছিল। তবে ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে আস্থর বিবাহের প্রচলনও ছিল। আস্থর বিবাহে মূল্যদান করে কন্যার পাণিগ্রহণ কবা হতে। মানবগৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে যে বিবাহ মাত্র দুই প্রকার—ব্রাহ্ম ও আস্থর ।
যদিও মহাভারতীয় যুগে গান্ধব ও রাক্ষস বিবাহ আদর্শ বিবাহ বলে গণ্য হতো, স্মৃতির যুগে এই উভয় প্রকাব বিবাহই অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মশাস্ত্রসমূহে বলা হয়েছে যে এরূপ বিবাহ করলে মানুষকে মহাপাপে লিপ্ত হতে হয়। বৌধায়ন একথাও বলেছেন যে, যদি কোন মেয়েকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে বিন মন্ত্রপাঠে বিবাহ করা হয় (রাক্ষস বিবাহ ), তা হলে তাকে কুমারী কন্যা হিসাবে পুনরায় বিবাহ দেওয়া চলে। পুরাণে এইরূপ বিবাহকে অস্বীকার করা হয়েছে, যদিও মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, বীরপুরুষদের পক্ষে গান্ধৰ্ব অপেক্ষ রাক্ষস বিবাহ অধিকতর শ্রেয়।
যদিও আস্থর বিবাহের প্রচলন নিশ্চয়ই ছিল,তথাপি স্মৃতিকারগণ ক্রমশ এরূপ বিবাহের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। মনু এরূপ বিবাহের অনুমোদন করে এক জায়গায় বলেছেন যে, “কস্তার জন্ত পণ বা মূল্য গ্রহণ করা, পিতার স্বাভাবিক অধিকার।” আবার অন্যত্র আমুর বিবাহ সম্পর্কে মনু বিরূপ মত প্রকাশ করেছেন। মনুসংহিতার দুজন প্রধান টীকাকার মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্টও এরূপ বিবাহকে নিকৃষ্ট বিবাহ বলেছেন। অনুরূপভাবে বৌধায়নও এক স্থানে বলেছেন যে, “ক্ষত্রিয়ের পক্ষে আস্থর বিবাহ বৈধ”, আবার অন্যত্র তিনি এর অননুমোদন করেছেন। নারদও এর নিন্দ করে বলেছেন, “বিনাপণে যেখানে স্ত্রী গ্রহণ করা হয়েছে, মাত্র সে ক্ষেত্রেই স্বামী প্রকৃত স্বামী ; অপর পক্ষে যেখানে কন্যাপণ দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের অধিকারিণী স্ত্রী, স্বামী নন।” যা হউক, স্মৃতিকারগণ কর্তৃক এরূপ বিরূপ মত প্রকাশ করা সত্বেও পরবর্তীকালে আস্থর বিবাহই এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কেন-না, বর্তমানে আস্থর বিবাহ হিন্দু সমাজে নিম্ন জাতিসমূহের মধ্যে ও আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।
এ সম্পর্কে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় অবস্থিত গ্রীক দেশীয় রাজদূত মেগাস্থিনিস তক্ষশিলায় যে প্রথা প্রচলিত থাকতে দেখেছিলেন তার উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, “যারা দারিদ্র্যের জন্য কন্যাকে সুপাত্রে দিতেপারেন না, তারা যুবতী কন্যাদের হাটে নিয়ে গিয়ে, সেখানে ঢাক ঢোল বাজিয়ে জনতার সমাবেশ করান। যখন জনতার মধ্য থেকে কেহ বিবাহ ইচ্ছুক হয়ে এগিয়ে আসে, তখন কস্তাকে সম্পূর্ণ অনাবৃত করে তাকে নিরীক্ষণ করতে দেওয়া হয়। প্রথমে সে কন্যার পশ্চাদভাগ নিরীক্ষণ করে, পরে নিরীক্ষণ করে তার সম্মুখভাগ। যদি কন্যাকে তার পছন্দ হয় তা হলে উপযুক্ত পণ দিয়ে সে তাকে নিয়ে যায় এবং তার সঙ্গে স্বামীস্ত্রী রূপে বসবাস করে।
স্মৃতির যুগে বিবাহ যে কেবল সর্বজনীন ছিল তা নয়, বিবাহ বাধ্যতামূলক-ও ছিল। পুত্র উৎপাদন করে পিতৃপুরুষদের নরক থেকে উদ্ধার করবার জন্য পুরুষদের তো বিবাহ করতেই হতো। যথাসময়ে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধেও সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থেই বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মেয়েদের পক্ষে বিবাহের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে দশ, যখন সে “কন্যা” আখ্যা লাভ করে। আরও বলা হয়েছে যে এই বয়সেই কন্যা, নারীর দৈহিক উৎকর্ষতা লাভ করে। পরাশর বিধান দিয়ে বলেছেন যে “যথাসময়ে যদি মেয়ের বিবাহ দেওয়া না হয় তা হলে সেই কন্যার মাসিক রজঃ অপর জগতে তার পিতৃপুরুষদের পান করতে হয় এবং যে তাকে বিবাহ করে, তাকে হতভাগ্য হতে হয়।” তবে বিষ্ণু বলেছেন, “বিবাহের পূর্বে কন্যা যদি পিতৃগৃহে রজস্বলা হয়, তা হলে সে “বৃষলী” ( অস্পৃষ্ঠা ) অবস্থা প্রাপ্ত হয় কিন্তু যে তাকে বিবাহ করে তার কোন অপরাধ হয় না।” বশিষ্ঠ, বৌধায়ন, নারদ ও যাজ্ঞবল্ক্য এ সম্পর্কে খুব রেগে গিয়ে বলেছেন, “কুমারী অবস্থায় কন্যা যতবার রজস্বলা হবে, ততবার তার পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের ভ্রুণহত্যার পাপে লিপ্ত হতে হবে।” গৌতমও এ সম্বন্ধে অন্যান্য স্মৃতিকারগণের সঙ্গে মতৈক্য দেখিয়ে বলেছেন “রজস্বলা হবার আগেই কন্যার বিবাহ দেওয়া চাই।”
ঋতু সঞ্চারের পূর্বেই কন্যার বিবাহ দেওয়া সম্বন্ধে স্মৃতিকারদের যত্নবান হবার কারণ হচ্ছে কন্যার ঋতুর যাতে সদ্ব্যবহার হয়। বলা হয়েছে, “ঋতু কন্যাকে কলুষমুক্ত করে তাকে বিশোধন করে এবং তাকে গর্ভধারণের উপযুক্ত করে।” এই কারণে স্মৃতিকারগণ বিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, ঋতু যেন অব্যবহৃত থাকে, বৃথা নষ্ট না হয়। আরও বলা হয়েছে যে “ঋতুর প্রথম চারদিন ছেড়ে দিয়ে স্বামী যেন নিশ্চয়ই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন।” “যে ব্যক্তি ঋতুচক্রকালে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন না, তিনি অনন্তকাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন ।” অনুরূপভাবে বলা হয়েছে, যে স্ত্ৰী ঋতুকালে তার কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয় না, তাকে নরক বাস করতে হয় এবং তার স্বামী ভ্রুণহত্যার পাপে লিপ্ত হন ।”