রামায়ণ ও বৌদ্ধজাতক গ্রন্থে বিবাহের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সে সম্বন্ধে এখানে কিছু বলা যেতে পারে। রামায়ণী যুগে রাজারাজদের মধ্যে স্বয়ম্বর প্রথায় বিবাহ করাই প্রচলিত রীতি ছিল। তবে বলপূর্বক হরণ করে এনেও যে বিবাহ করা হতো তা রাবণ সীতার উপাখ্যান থেকে বুঝতে পারা যায়। ভ্রাতৃজায়াকে বিবাহ করার রীতিও যে ছিল, তা সুগ্ৰীব কর্তৃক মৃত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বালীর স্ত্রী তারার বিবাহ থেকে বোঝা যায়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর সহিত বিভীষণের বিবাহও এ সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে। এ যুগে সহোদরা ব্যতীত অন্য ভগিনীকে বিবাহ করার রীতিও প্রচলিত ছিল। . এ সম্পর্কে রামায়ণে অন্তত একটি দৃষ্টান্ত আছে । রাজা দশরথের সহিত কৌশল্যার বিবাহ। দশরথ কোশল রাজবংশের নৃপতি ছিলেন। কৌশল্যাও যে সেই বংশেরই কন্য ছিলেন, তা তার নাম থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে। সুতরাং নিজবংশেই যে রাজা দশরথ বিবাহ করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । দশরথের বিবাহ যে ভগিনীর সহিত হয়েছিল, তা দশরথ-জাতকেও উল্লিখিত হয়েছে। বস্তুত বৌদ্ধ পালিগ্রন্থ সমূহে উত্তর ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে এরূপ ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে বিবাহের বহু কাহিনী নিবদ্ধ আছে। যেমন : নন্দিতা বিবাহ করেছিল তার মাতুল কন্যা রেবতীকে। অৰ্দ্ধমাগধী ভাষায় রচিত জৈন সাহিত্যেও এরূপ বিবাহের উল্লেখ আছে। শালিবরণ বা শু্যালিকাকে বিবাহ করার রীতিও যে ছিল, তা নাভী কর্তৃক দুই যমজ ভগিনীর বিবাহ থেকে বুঝতে পাবা যায়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে এই দুই যমজ ভগিনীর অন্ততরা মরুদেবী জৈন তীৰ্থংকর ঋষভের মাতা ছিলেন। বসুদেব কর্তৃক দেবক রাজার সাত কন্যাকেবিবাহ ও কংশ কর্তৃক জরাসন্ধের দুই কন্যাকে বিবাহ ও শালিবরণের দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা আগেই দেখেছি যে বৈদিক যুগে ভাবীর উপর দেবরের যৌন সংসর্গের অধিকার ছিল। এই কারণে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে “দত্তক” গ্রহণের প্রশ্ন বৈদিক যুগে উঠতে না। কিন্তু পরবর্তীকালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়ার সহিত অবাধ মিলনের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন এবং মাত্র “নিয়োগ” প্রথার ভেতর দিয়ে তাকে এরূপ সংসর্গের সীমিত অধিকার দেওয়া হয়েছিল ।
স্বামী ব্যতীত অপর পুরুষের সহিত যৌনমিলনের যে দুষ্টান্ত ইতিপূর্বে মহাভারত থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, ঐ যুগে স্ত্রীলোকের সতীত্বের অন্য তাৎপর্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে, বিশেষ করে রামায়ণী যুগের সমাজে সতীত্বের অন্তরূপ মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পতিব্ৰতা স্ত্রীলোককেই সতী বলা হতো। উত্তরকালের হিন্দুসমাজ সতীত্বের এই মূল্যায়নই গ্রহণ করেছিল এবং একমাত্র পতিব্ৰতা স্ত্রীলোককেই সতী বলে গণ্য করা হতো। কোন স্ত্রীলোকের সতীত্ব সম্পর্কে সংশয় হলে তাকে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হতো। সীতাকে এইরূপ অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তবে সীতার অগ্নিপরীক্ষার যে প্রণালী রামায়ণে বিবৃত হয়েছে, তা ছাড়াও আর এক রকমের অগ্নিপরীক্ষা প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল । কোন নারীর সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ হলে, তাকে লাঙ্গলের অগ্নিতপ্ত লৌহশলা লেহন করে নিজের পবিত্রতা প্রমাণ করতে হতো। জিহবা দগ্ধ না হলে, সে নারী যে যথার্থই সতী তা প্রমাণ হয়ে যেতো।
০৩. যৌনাচারের উপর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব
পূর্ব অধ্যায়ে মহাভারতীয় যুগের বিশ্রস্ত যৌনজীবনের যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা নানারকম ভাবে বিধান ও অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল স্মৃতি ও পুরাণের যুগে। স্মৃতি বলতে হিন্দুদের বিধান শাস্ত্রসমূহকে বোঝায়। এগুলির অপর নাম ছিল ধর্মশাস্ত্র। এগুলি সনাতন ধর্মের আধার। পুরাণগুলি প্রাচীন ঐতিহ্যের সংগ্ৰহ ভাণ্ডার। ধর্মশাস্ত্রকারদের মধ্যে যারা প্রাধান্ত লাভ করেছিলেন র্তারা হচ্ছেন মনু, বিষ্ণু, যাজ্ঞবল্ক্য, বৃহস্পতি, নারদ ও আপস্তম্ভ। তবে এগুলির মধ্যে মনু রচিত মানব ধর্মশাস্ত্র বা মনুসংহিতাই হিন্দুর ধর্ম, সমাজ, আচার ব্যবহার ও বিধানের আদর্শ নির্দেশক গ্রন্থ। হিন্দুর কাছে মনুর বিধানই শিরোধার্য। একথা বৃহস্পতি স্বীকার করে গেছেন। বৃহস্পতি বলেছেন, “মস্বর্থবিপরীত যা সা স্মৃতির্ণ প্রশস্ততে।” তার মানে, যে স্মৃতি মনুর বিপক্ষে বিধান দেয়, সে স্মৃতি স্মৃতিই নয়। যদিও মনুর উক্তিসমূহ অতি প্রাচীন, তথাপি সংগৃহীত অবস্থায় মনুর মানবধর্মশাস্ত্র অনেক পরে সংকলিত হয়েছিল। কথিত আছে, সর্বপ্রথম এতে একলক্ষ শ্লোক ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ২,৬৮৪টি শ্লোক আছে। পণ্ডিতমহল এরূপ অনুমান করেন যে ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ সমূহ খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্ৰীষ্টাব্দের পঞ্চম শতকের মধ্যে সংকলিত হয়েছিল।
মনুর মানবধর্মশাস্ত্রে যে সমাজবিদ্যাসের চিত্র দেওয়া হয়েছে, তা চতুবণের উপর প্রতিষ্ঠিত। চতুবৰ্ণ বলতে মৌলিক চারটি শ্রেণীকে বোঝাতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্ব ও শূদ্র। তবে মানবধর্ম শাস্ত্রের দশম অধ্যায়ে এক সম্প্রসারিত সমাজের চেহারাও দেখতে পাওয়া যায়। উপরোক্ত চারিবর্ণের মধ্যে অসবর্ণ যৌনসংসর্গের ফলে অনেক সংকরজাতির উদ্ভব হয়েছিল। দশম অধ্যায়ে এই সকল সংকর জাতির যে নাম দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে মুর্ধাভিষিক্ত, মাহিষ, করণ বা কায়স্থ অম্বষ্ট বা বৈদ্য, অয়োগব, ধিগবন, পুঙ্কস ও চণ্ডাল। এদের সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন কর্ম বা বৃত্তি ছিল । সুতরাং বৃত্তিভিত্তিক জাতি ব। শ্রেণীর উদ্ভব এযুগেই হয়েছিল।