০১. যৌন জীবনের পটভূমিকা
প্রাণী জগতে মানুষই বোধ হয় একমাত্র জীব যার যৌন ক্ষুধা সীমিত নয়। অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌন মিলনের একটা বিশেষ ঋতু আছে। মাত্র সেই নির্দিষ্ট ঋতুতেই তাদের মধ্যে যৌন মিলনের আকাজক্ষা জাগে এবং স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয়। একমাত্র মানুষেরই ক্ষেত্রে এরূপ কোন নির্দিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের মধ্যে যৌন মিলনের বাসনা সকল ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। এই কারণে মানুষের মধ্যে স্ত্রীপুরুষকে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে দেখা যায়। বস্তুত, মানুষের মধ্যে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকা, স্ত্রী-পুরুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষের মধ্যে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে। পরিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্র থাকার অবশ্য আরও কারণ আছে । সেটা হচ্ছে বায়োলজিকাল বা জীবজনিত কারণ। শিশুকে লালন-পালন করে স্বাবলম্বী করে তুলতে অন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের অনেক বেশী সময় লাগে। এ সময় প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষণের জন্ত নারীকে পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়। মনে করুন অন্য প্রাণীর মত, যৌন মিলনের অব্যবহিত পরেই স্ত্রী-পুরুষ যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতো, তা হলে মা ও সন্তানকে কী না বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো। বস্তুত, আদিম যুগে নারীকে সব সময়ই পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হতো। যুগে যুগে যদিও নারী নির্যাতিত হয়েছে পুরুষের হাতে, তথাপি সে তার প্রেম, ভালবাসা ও সোহাগ দ্বারা পুরুষকে প্রলোভিত করেছে তার অতি নিকট সান্নিধ্যে থাকতে ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মনুষ্য-সমাজে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে জীবজনিত কারণে। বিবাহ দ্বারা পরিবারের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে অনেক পরে এবং এক বিশেষ প্রয়োজনে। আদিম মানুষের পক্ষে খাদ্য আহরণ করা ছিল, এক অতি কুরাহ ব্যাপার। পশু মাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য। পশু শিকারের জন্য আদিম মানুষকে প্রায়ই নিজের আশ্রয় ছেড়ে অনেক দূরে যেতে হতো। অনেক সময় তাকে একাধিক দিনও দূরে থাকতে হতো। এভাবে পুরুষ যখন দূরে থাকতো, তখন তার নারী থাকতে সম্পূর্ণ অসহায় ও রক্ষকহীন অবস্থায়। অপর কোন পুরুষ তাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে গেলে, যুদ্ধ ও রক্তপাতের স্বষ্টি হতো। এরূপ রক্তপাত পরিহার করবার জন্তই, মনুষ্য সমাজে বিবাহ দ্বারা স্ত্রীপুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। প্রখ্যাত নৃতত্ববিদ ওয়েস্টারমার্ক বলেন—“পবিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্র বাস করা থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে বিবাহ প্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয় নি।”_ মহাভারতে বিবৃত শ্বেতকেতু উপাখ্যান থেকেও আমরা এব সমর্থন পাই। সেখানে বলা হয়েছে যে শ্বেতকেতুই ভারতবর্ষে প্রথম বিবাহ প্রথার প্রবর্তন করেন। কিন্তু বিবৃত কাহিনী থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তার আগেই শ্বেতকেতু তাঁর পিতামাতার সঙ্গে পরিবার মধ্যে বাস করতেন।
যদিও পণ্ডিত মহলে আজ একথা একবাক্যে স্বীকৃত হয়েছে যে পরিবার থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে, তথাপি বাখোফেন, মরগান প্রভূতি নৃতত্ববিদগণ একসময় একথা স্বীকার করতেন না। তারা এই মতবাদ প্রচার করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, বিবাহ প্রথা উদ্ভব হবার আগে মানুষের মধ্যে কোনরূপ স্থায়ী যৌনসম্পর্ক ছিল না। র্তারা বলতেন যে অন্যান্ত পশুর মত মানুষও অবাধ যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হতো। র্তাদের মতে আদিম অবস্থায় মামুষের মধ্যে যৌনাচার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন অনুশাসন ছিল না। র্তারা বলতেন যে অনুশাসনের উদ্ভব হয়েছিল অতি মন্থর গতিতে, ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে। র্তাদের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে নানারকম বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল, সেগুলিকে তারা এক বিবর্তনের ঠাটে সাজিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন যে মানুষের বর্তমান একপত্নীক বিবাহ প্রথা এই সকল ক্রমিক স্তরের ভেতর দিয়ে বিকাশ লাভ করেছে।
সন্তানকে লালন-পালন ও স্বাবলম্বী করে তোলবার জন্য মানুষের যে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন হয়, একমাত্র এই জীবজনিত কারণই একথা প্রমাণ করবার পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক যে মনুষ্য সমাজে গোড়া থেকেই স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে থাকতো। বস্তুত আদিম অবস্থায় স্ত্রী-পুরুষ যে অবাধ যৌনাচারে রত ছিল, এই মতবাদ পূর্বোক্ত নৃতত্ববিদগণের এক নিছক কল্পনামূলক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ অবাধ যৌনমিলন মনুষ্যসমাজে কোনদিনই প্রচলিত ছিল না । এমন কি বর্তমান সময়েও অত্যন্ত আদিম অবস্থায় অবস্থিত বনবাসী জাতিসমূহের মধ্যেও অবাধ যৌনমিলনের কোন রীতি নেই। বস্তুত এই সকল বনবাসী অসভ্য জাতিসমূহের মধ্যে যে সকল বিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে, তা অতি কঠোর অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির মধ্যে পর্যবেক্ষণ করলেও আমরা এর সমর্থন পাই। বনমানুষ, গরিলা প্রভৃতি যে সকল নরাকার জীব আছে, তারাও দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করে, কখনও অবাধ রমনে প্রবৃত্ত হয় না। এই সকল কারণ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বিবাহ আখ্যা দিয়ে তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকুক আর না থাকুক, স্ত্রী-পুরুষের একত্রে মিলিত হয়ে পরিবার গঠন করে সহবাস করবার রীতি মনুষ্য সমাজে গোড়া থেকেই ছিল।