Neo-Platonism-এ আছে –“As being the cause of all things, it is everywhere, and not also nowhere’, it would be all things.”(২৮)
শেখ শিহাবুদ্দীন সুহরাওয়াদী ওর্ফে শেখুল ইশরাক মকুল (বারো শতকের মধ্যভাগ) মুসলিম জগতে স্বাধীন চিন্তার অন্যতম প্রবর্তক। নতুন তত্ত্ব চিন্তার অপরাধে ইনি ছত্রিশ বছর বয়সে নিহত হন সুলতান সালাহুদীনের আদেশে। তাঁর মতো আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্বু জ্যোতি (Nur-l-Qahr) Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতোপ্ৰকাশ। কাজেই আলো-অন্ধকারের মগনীয় দ্বৈততত্ত্ব এখানে অস্বীকৃত। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সূফী ব্ৰত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ইনসানুল কামেলা’। অবশ্য এই ইনসানুল কামেল” নীটশের কিংবা বাৰ্নাড শ-এর Superman নয় ; প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের।
মোটামুটিভাবে বলতে গেলে পাক-ভারতে (ক) চিশতিয়া, (খ) কাদেরিয়া, (গ) সোহরাওয়ার্দীয়া ও (ঘ) নকশবন্দিয়া–এর চারটি মতবাদই প্ৰধান। অন্যান্যগুলো এ চারটির উপমাত মাত্র।(২৯)
বাঙলার সূফী সাহিত্য
সুতরাং শাত্তারিয়া, মদারিয়া, কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রত্যেকটি উক্ত চারটির যে কোনো একটির উপমত।(৩০)
১. অদ্বৈতবাদ, ২, সৰ্বেশ্বরবাদ, ৩. দেহতত্ত্ব (কুণ্ডলিনী শক্তি), ৪. বৈরাগ্য, ৫. ফানাতত্ত্ব, ৬. সেবাধর্ম ও মানবগ্ৰীতি, ৭. গুরু বা পীরবাদ, ৮, পরব্ৰহ্ম ও মায়াবাদ, ৯. ইনসানুল কামেল তথা সিদ্ধপুরুষবাদ, ১০. স্রষ্টার লীলাময়ত প্রভৃতি ধারণার বীজ বা প্রকাশ ছিল আরব-ইরানের সূফী তত্ত্বে।
ভারতের মাটিতে অনুকূল আবহে এসব প্রবল হতে থাকে সূফীতত্ত্বে। এখানে সূফীমতে স্থানিক প্রভাব লক্ষণীয়। ইসলাম ও সূফী-মতের প্রভাবে ভাবতেও দেখা দেয় চিন্তা-বিপ্লব। আমরা এদেশে ইসলামী প্রভাবের দু’চারটি নমুনা দিয়ে পরে দেশী প্রভাবের পরিচয় নেব মুসলিম জীবনে ও চিন্তায়।
৫
ভারতে “একেশ্বরবাদ, ভক্তিবাদ, বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈবধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড়দেশে, নবীন ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দু ধর্মের ঘাত প্ৰতিঘাতের ফলেই দক্ষিণ ভারতে এই নতুন ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে।.ইসলামের এক দেবতা ও এক ধর্মের বিপুল বন্যর মুখে দাড়িয়ে শঙ্কর আপসহীন অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন।… শঙ্করাচার্যের আপসহীন অদ্বৈতবাদ মনে হয় যেন নবীন আরবী ইসলামেব একেশ্বরবাদের ভারতীয় রূপ। বেদ-উপনিষদ তার উৎস হলেও ইসলামের প্রভাবেই যে সেই উৎস সন্ধানের প্রেরণা এসেছে এবং ‘অদ্বৈতবাদের’ পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর হয়েছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। শঙ্করাচার্যের পরে রামানুজ, বিষ্ণুস্বামী, মাধবাচার্য ও নিম্বার্কের দর্শনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে, দেখা যায়. ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমান বিচার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান সাধকরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এদেশে প্রচার করেছেন, রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শঙ্করের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধাভক্তি প্রীতির স্তরে নেমে এলেন।(৩১)
এই মতই ব্যক্ত হয়েছে ডক্টর তারাচাঁদের Influence of Islam on Indian Culture গ্রন্থে।(৩২)
উমেশচন্দ্ৰ ভট্টাচাৰ্যও বলেন “একেশ্বরবাদ ভারতেও ছিল, বাহির হইতেও আসিয়াছিল উভয়ে মিলিয়া দশম একাদশ শতাব্দীতে একটা পরিপুষ্ট আকারে দেখা দেয়।…তাহাদের (মুসলমানদের) একেশ্বরবাদের সংস্পর্শে আসিয়া ভারতের একেশ্বরবাদ বিশেষত বৈষ্ণব একেশ্বরবাদ উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠে নাই এমন কথা বলিতেও আমাদের সঙ্কোচ বোধ হইতেছে।”৩৩
উত্তর ভারতেও সন্ত ধর্মের উদ্ভব হয় মুসলিম প্রভাবে। রামানন্দ, কবির, নানক, দাদু, একলব্য, রামদাস প্রমুখ কমবেশী মরমীয়াবাদই প্রচার করেছেন।
ভারতে এসে এদেশী ধর্ম, আচার ও দর্শনের প্রভাবে পড়েছিল মুসলমানরা। রাম-সীতা ও রাধা-কৃষ্ণের রূপকে বান্দা-আল্লাহর তথা ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক, ভক্তি, প্ৰেম, বিরহবোধ কিংবা মিলনাকাজক্ষা প্ৰকাশ করেছেন মধ্য-উত্তর ভারতীয় মুসলমানরা। কবির, এয়ারী, রজব, দরিয়া, কায়েম প্ৰমুখের গান তার প্রমাণ। বাঙলা দেশেও চৈতনোত্তরযুগে মুসলমানরা অধ্যাত্মপ্রেমজ হৃদয়াকুতি প্ৰকাশ করেছেন রাধা-কৃষ্ণ প্রতীকের মাধ্যমে। সৈয়দ মর্তুজার ফারসী গজলে রাধা-কৃষ্ণ নেই, আবার নুর কুতবে আলমের বাঙলা পদে রয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের রূপক এতেই বোঝা যায়, অধ্যাত জিজ্ঞাসায় দেশী ভাষানুগ রূপকে অবহেলা করেননি তাঁরা। দেশজ মুসলমানের পূর্ব সংস্কার বশে, চৈতনোত্তরযুগে রেওয়াজের প্রভাবে এবং ভাবসাদৃশ্যবশত সূফীতত্ত্বের রূপক হিসেবে রাধা-কৃষ্ণ-প্রতীক মুসলিম মরমীয়ারা গ্ৰহণ করেছেন বলে অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচাৰ্যও অভিমত প্ৰকাশ করেছেন তাঁর বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ গ্রন্থে।(৩৪) ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্তও বলেন, “একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে বাংলার মুসলমান কবিগণ রাধাকৃষ্ণকে লইয়া যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহা কোনও বিধিবদ্ধ বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় রচিত নহে।.তাহারা চৈতন্য প্রবর্তিত একটি সাধারণ প্ৰেম ধর্মের প্রভাব সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রেই পাইলেন, কিন্তু পাইলেন না। রাধাকৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধে কোন স্থিরবদ্ধ ভাবাদৃষ্টি। সুতরাং বাংলার জনসমাজে যে সাধারণ ভক্তিধর্ম ও যোগধর্ম প্রচলিত ছিল, এই সকল কবিগণ রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সেই সকলের সঙ্গেই যুক্ত করিয়া লইলেন। বাংলা দেশের প্রেমপন্থী মুসলমান সাধকগণ অল্পবিস্তর সকলেই সূফীপন্থী।… রাধার যে পূর্বরাগ অনুরাগ বিরহের আর্তি তাহা কবিগণের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পরম দায়িতের জন্য নিখিল প্রেম সাধকগণের পূর্বরাগ বিরহের আর্তিতেই পরিণতি লাভ করিয়াছে এবং সেই আর্তির ক্ষেত্রে কবি নিজেকে শুধু দর্শক বা আস্বাদকরূপে খানিকটা দূরে সরাইয়া লন নাই, নিখিল আর্তির সহিত নিজের চিত্তের আর্তিকেও মিলাইয়া দিয়াছেন।…আমরা মুসলমান কবিগণের রচিত রাধাকৃষ্ণ-লীলা সম্বন্ধীয় পদগুলির ভণিতা লক্ষ্য করিলেই এই কবিগণের মূল ভাবাদৃষ্টিরও ইঙ্গিত পাইব।(৩৫)