৩
কিন্তু প্রচলিত বিভিন্ন শাখার সূফী মতগুলো ভিন্ন ধরনের। ইসলামের মৌল অঙ্গীকারের সঙ্গেও পার্থক্য কম নয় এগুলোর। এ না হয়ে পারেনি। কেননা সূফীমত একটি মিশ্রদর্শনের সন্তান। তাও আবার একক মত থাকেনি। তাই আজকেব দিনে সূফীমতে বলতে মত-সমষ্টিই বোঝায়। ইসলামের উদ্ভবের প্রায় দেড়শ বছর পর থেকে সন্তৰ্পণে অঙ্কুরিত হতে থাকে এ মত। কুফার আবু হাশিমই (মৃত্যু : ১৬২ হিঃ) প্রথম সূফী বলে পরিচিত। তিনি হুজুইরীর সংজ্ঞানুগ সূফী। আসলে ইব্রাহীম আদহম (মৃত্যু ১৬২ হিঃ), ফজিল আয়াজ (মৃত্যু ১৮৮হিঃ), মারুফ কখী, দাউদ তায়ী (মৃত্যু : ১৬৫ হিঃ) হাসান বসোরী প্ৰমুখের সাধনা ও বাণী থেকেই বিশিষ্ট হয়ে উঠে সূফী মত।(২২)
খ্রীস্টানদের মধ্যে বৈরাগ্য ছিল, ইহুদীরাও ছিল তত্ত্ব জিজ্ঞাসু। আরবেরা চিরকাল পেয়েছে। এদের সান্নিধ্য। স্বয়ং হযরত মুহম্মদ নবুয়ত লাভের পূর্বে মধ্যে মধ্যে নিভৃত চিন্তায় মগ্ন থাকতেন হেবা পর্বতের গুহায়। ভোগবিমুখতা ও বিষয়ে অনাসক্তি তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ইরানে জোরাষ্ট্রীয়রা তত্ত্ববিমুখ হলেও মানী এবং মজদ্দকীদের মধ্যে দুর্লভ ছিল না। মরমীয়াভাব ও তত্ত্বচিন্তা। বৌদ্ধ নির্বাণবাদ ও গুরুবাদের সংস্কারও মিশে ছিল অনেকের মজ্জায়। ২৩ আর স্বেচ্ছাবৃত দারিদ্র্যে অনাড়ম্বর জীবন ছিল রসুল-পার্ষদদের আদর্শ। ২৪ এক সময় এমনি আদর্শ ধাৰ্মিকরা ভোগবিমুখতা ও বিষয় বৈরাগ্যের জন্যে সাধারণ্যে পরিচিত হয় ফকির মানে। একই কারণে কালে ফকির, দরবেশ ও সূফী–শব্দত্রেয় হয়ে উঠে অভিন্নার্থক। ইবনে ইসলাম বিস্তৃতির পরে মানী, মজদ্দকী, যিনদিকী (Zindiqu) ও বৌদ্ধসংস্কারের তথা দেশকালের প্রভাব থেকে পুবো মুক্ত হতে পারেনি মুসলমানেরা। আদর্শ মুসলিমের পার্থিব ব্যাপারে অনাসক্তি, পবিত্রতার সাধনা ও আল্লাহ্র যিকর-এর সঙ্গে যেমন মিশে ছিল এই পূর্ব-সংস্কারের উত্তরাধিকার তেমনি আব্বাসীয়দের আমলে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলীয় ও নব্য প্ল্যাটোনিক মতের প্রভাবও পড়েছিল সুপ্রচুর। অবশ্য ইসলাম পূৰ্বযুগেও সিরিয়ায় আর ইরানে অনুভূত হত এ্যারিস্টটল ও প্ল্যাটোর দর্শনের প্রভাব।(২৫)
৪
ভারতে বিভিন্ন সূফীমতের উপর স্থানিক প্রভাব পড়েছে প্রচুর। নকশীবন্দিয়া মতবাদে ও সাধনতত্ত্বে ভারতীয় দেহতত্ত্ব ও যোগের প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশী। তারাও স্বীকার করে কুণ্ডলিনী শক্তি। ষড়কেন্দ্রী দেহে ষড়রঙের আলো সন্ধান করা এবং সেই ষড়বর্ণের জ্যোতিকে বর্ণহীন জ্যোতিতে পরিণত করাই সাধনার লক্ষ্য। এটি শিব-শক্তি মিলন জাত আনন্দের কিংবা বৌদ্ধ সহজানন্দের আদলে পরিকল্পিত।
বিভিন্ন সূফীমতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার : আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকীক বলখী, ইব্রাহীম আদহাম, রাবিয়া বসোয়ী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহু প্রেম ও পাপভীতিই এমতের সূফীদের বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্ৰেমকামী রূপে কল্পনা করেছেন যারা, তাদের মতে আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। তুলনীয় : রূপ দেখি আপনার, কৃষ্ণ হয় চমৎকার, আস্বদিতে সাধ উঠে মনে; অথবা, রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি অন্যে অন্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সূফীরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হয়েছে প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্ৰেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সূফীরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্ৰেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। জোরাষ্ট্ৰীয় প্রভাব আছে। এরূপ তত্ত্বচিন্তায়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্ৰেমানলে–হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহু। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্ব–যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহিম” বোধে। এই মতের সূফীদের মধ্যে বায়জিদ বিস্তামী, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। এই বোধেও বৈদান্তিক প্রভাব সুস্পষ্ট। জীবাত্মা এখানে পরমাত্মারই খণ্ডাংশ মাত্র। এবং সৃষ্টি মাত্রই ব্ৰহ্মেরই বিকাশ ও প্রকাশ এবং “একোহিম বহুস্যাম’ তত্ত্বভিত্তিক। নাসাফি (Nastafii) পষ্ট করেই বলেছেন “ওহে দরবেশ, তুমি কি মনে করু, তোমার আল্লাহ্বিহীন স্বাধীন সত্তা আছে? তা হলে এ তোমার ভুল।(২৬) আবার শঙ্করের মায়াবাদও অনুপ্রবেশ করেছে এখানে। সৃষ্টি মাত্রই ব্ৰহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্ৰহ্মেতে লীন। কাজেই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা বিরহানুভূতি অবিদ্যাজাত একটি সাময়িক বোধ-বিকৃতি মাত্র। মায়াজাত বিভ্রান্তি থেকে “অহং এর উৎপত্তি। অহংবোধ তথা নিঃসহায় নিঃসঙ্গ স্বাধীন সত্তাবোধ থেকেই দুঃখের জন্ম। এ বোধ মুখ্যত বৌদ্ধের। বিবর্তনবাদ তথা জন্মান্তরবাদেও আস্থা রেখেছেন রুমী।(২৭) আমরা একদিকে নব প্ল্যাটোনিক তত্ত্বের এবং অপরদিকে বৌদ্ধ জীবনবোধ ও জন্মান্তরিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করি এতে।