এই প্রজ্ঞাকে সূফীরা কোরআনোক্ত ব্যবহার-বিধি বহির্ভূত অধ্যাত্মতত্ত্বজ্ঞান” বলে ব্যাখ্যা করেন।
আর একটি আয়াতে আছে, “এবং যারা বিশ্বাস করে তাদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শন রয়েছে এবং তোমার নিজের মধ্যে তুমি কি তা দেখা না!”৩ আবার আমরা তার (মানুষের) ঘাড়ের রাগ বা শিরার চেয়েও নিকটতর।”৪ “আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশের জ্যোতিঃ স্বরূপ।”৫ উটের দিকে তাকিয়ে দেখ, কি কৌশলে তা সৃষ্টি হয়েছে। আকাশের মহিমা দেখ, পর্বতগুলো কেমন দৃঢ় করে স্থাপন করেছেন।”৬ “বল তা হচ্ছে আল্লাহর আদেশ বা শক্তি।”৭
কোরআনের এসব আয়াতের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপরেই সূফীবাদের ইসলামীরূপ প্রতিষ্ঠিত। আবার জ্যোতিঃতত্ত্বে মানী ও মজদ্দকী দর্শনের এবং আত্মতত্ত্বে সৰ্বেশ্বরবাদের এবং সৃষ্টির মহিমা ও বৈচিত্র্যতত্ত্বে ভাববাদের আশ্রয়ও মিলেছে।
O’ leary’র মতে “Plotinus এর Enneads, St. Paul-এর শিষ্য Dionysius ও Psendo Dionysius মতের ‘on Mystical Theology’ এবং ‘on the name’s of God’ প্রভৃতি খ্রীষ্টীয় মরমীয়াবাদের উৎস ছিল। Stephen Bar sudaılı alıas Hirothens নামে এক সিরীয় Monk-এর (খ্ৰীঃ ৫ম শতক) রচনাও সূফী মতবাদের উদ্ভবে পরোক্ষ সহায়তা করেছে।”
Akhlaq-i-Jalali থেকে Browne(৯) সূফী আবু সায়ীদ বিন আবুল খায়ের (মৃত্যু ৪৪১হিঃ-১০৪৯ খ্ৰীঃ) ও ইবনে সিনার আলাপ সম্বন্ধে যে-বৰ্ণনা দিয়েছেন, তাতে দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের অভিন্ন লক্ষ্যের আভাস মিলে, ইব্নে সিনা বলেছেন “what I know he sees, সায়ীদ মন্তব্য করেছেন “what I see he knows.”
সূফী মতের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন মিশরীয় কিংবা নুবীয় (Nubian) লেখক জুন নুন (মৃত্যু ২৪৫-৪৬ হিঃ)। তিনি ছিলেন মালিক বিন আনাসের শিষ্য। জুন নুনের রচনাবলী সুসংকলিত ও সুসম্পাদিত করেন জুনাইদ বাগদাদী (মৃত্যু ২৯৭ হিঃ)। এই গ্ৰন্থ সম্বন্ধে O’ leary বলেছেন,
“in it appears essential doctrine of sufism, as of all mysticism, the teaching of Tawhid, the final union of the soul with God, a doctrine which is expressed in a way closely resembling the neo-platonic teaching, save that in Sufism the means whereby this Union is to be attained is not by the exercise of the intuitive faculty of reason but by the piety and devotion.”১০ সূফীমতবাদ সৰ্বেশ্বরবাদের রূপ নেয় ইরানের সূফীদের দ্বারাই।(১১ জুনাইদের পরে তাঁর শিষ্য খোরাসানের আসশিবলীর (মৃত্যু ৩০৯ হিঃ) প্রচারণায় প্রসার লাভ করে এই মত।(১২ সৰ্বেশ্বরবাদী বা অদ্বৈতবাদী সূফীদের মধ্যে হোসেন বিন মনসুর হাল্লাজ (মৃত্যু ৩০৯ হিঃ), বায়জীদ বিস্তামী (ওর্ফে আবু এয়ীদ, মৃত্যু ২৬০ হিঃ) প্রভৃতি ছিলেন অদ্বৈতবাদী। এঁদের মতের সঙ্গে ঐক্য আছে বৈদান্তিক ধারণার। তবে বৌদ্ধ নির্বাণ ও ফানা অভিন্ন নয়। নিৰ্বাণ বিলয় জ্ঞাপক আর ফানা অখণ্ডে মিলন সূচক (বাকা)।
এঁরা জুলুল-এ বিশ্বাসী, অর্থাৎ জীবাত্মা যে পরমাত্মারই অংশ তা এঁদের বিশ্বাসের অঙ্গ। এ বিশ্বাস মূলত বৈদান্তিক। তবু আত্মপরমাত্মা সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টির ব্যাপারে নব প্ল্যাটোনিক মতেরই প্রভাব বেশী।(১৩) যিকর সূফীদের অবশ্য আচরণীয় চর্যা। এটিতে কোরআনেরও সমর্থন মিলে–আল্লাহকে ঘন ঘন স্মরণ করা।(১৪)
২
এ সূত্রে “কাশফ-অল-মাহজুব’-এ আলোচিত সূফী তত্ত্ব সম্বন্ধে একটি কথা বলা দরকার। সূফীমতের পরবর্তী বিকাশ ও বৈচিত্র্যর আলোকে বিচার করলে আলহুজুইরীর গ্ৰন্থকে কোরআনিক ইসলামের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা গ্ৰন্থ বলেই অভিহিত করতে হয়।
সূফীমতে বলতে আমাদের যে-ধারণা স্বভাবত আসে, তার সঙ্গে হুজুই্যৱী বৰ্ণিত সূফীমতের রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। কাশফ-আল-মাহজুব গুরুত্ব দিয়েছে Plain living and high thinking আদর্শে। ভগবৎপ্রেম ও আনুগত্যের অনুকুল বলে প্রচার করা হয়েছে দারিদ্র্যকে।(১৫) হুজুইরার মতে আত্মার পবিত্রতার (সাফা) সাধনাই সূফী সাধনা, কেননা মানুষ অপবিত্র (কদর)। তিনি মনে করেন, পার্থিব বিষয়ে ও ভোগে অনাসক্তি আর সত্যসন্ধ মনই সূফীর বিশেষ লক্ষণ এবং এসব গুণে হযরত আবু বকর সিদ্দিকী সূফী-প্রধান।(১৬) প্রেম ও পবিত্রতা যোগে যখন পার্থিব বন্ধন মুক্ত হয় সূফী, তখন সে যে দিব্যাবস্থা লাভ করে, তার ফলে ফানাফিল্লাহ স্তর প্রাপ্তি ঘটে তার। তখন সোনা ও মাটি দু-ই তার কাছে সমান।(১৭) অতএব যে আল্লাহ-প্রেমের দ্বারা বিশোধিত এবং আল্লাহতে (Beloved এ) যে বিলীন (absorbed) এবং যে সবকিছু ত্যাগ করেছে সে-ই সূফী।(১৮) এবং সূফীর জুনাইদ-প্রদত্ত সংজ্ঞা সমর্থন পেয়েছে উসমান হুজুইরীর। জুনাইদ বলেছেন, “সূফীর আটটি গুণ–ইব্রাহীমের মতো ত্যাগ, ইসমাইলের মতো আনুগত্য, আয়ুবের মতো ধৈৰ্য, জ্যাকিরিয়ার মতো বাকসংযম, John এর মতো আত্মপীড়ন, ঈসার মতো ভোগবিমুখতা, মুসার মতো পশমী পরিধেয় গ্রহণ এবং হযরত মুহম্মদের মতো দারিদ্র্য বরণ।”(১৯)
অতএব, হুজুইরী ইসলাম সম্মত অধ্যাতন্ত্ৰবাদ তথা মরমীয়াবাদের ভাষ্যকার। আসলে ইসলামেরই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা (spiritual interpretation of Islam) দিয়েছেন তিনি। তাঁর ধারণায় আসহাবে কাহাফ, হযরত মুহম্মদের ভোগবিমুখতা, দারিদ্র্য, আসহাবে সাফফার বৈরাগ্য, আবুবকর সিদিকের ত্যাগশীলতা, হারিসের স্রষ্টা-প্ৰেম, আবু হাশিমের অনাড়ম্বর জীবন, দেহমন-আত্মার পবিত্ৰতা রক্ষার সাধনা প্রভৃতিই সূফীর লক্ষণ। তিনি ‘বাকা-বিল্লাহ’-এ আস্থাবান নন। পক্ষান্তরে ‘ফানায়’ তথা complete surrender to the will of Allahতে–যা ইসলামের দ্বৈতবাদী তথা একেশ্বর তত্ত্বে আস্থাবান। তিনি শরীয়ৎ তথা কোরআন হাদিসোত্ত আচারে নিষ্ঠ।(২০) কাজেই হুজুইরীর সূফীতত্ত্ব আসলে শরীয়তী মুসলমানের আল্লাহু গ্ৰীতিজাত বৈরাগ্য। এক বিদ্বানের ভাষায় “It was an asceticism in the puritanical sense.”(২১)