যোগে সিদ্ধিলাভ হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি অর্জন। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে তখন মানুষ অসামান্য শক্তির অধিকারী হয়ে অসাধ্য সাধন করে। শুক্র থাকে লিঙ্গের কাছে। সেটাকে প্ৰজনন শক্তির প্রতীক স্বরূপ মনে করা হয়েছে। কুণ্ডলীকৃত সুপ্ত সৰ্পের কল্পনাই নাম পেয়েছে কুণ্ডলিনী। এর মধ্যে রয়েছে কামবিষ। সে কামবিষ সৃষ্টিশীল। শুক্ৰ স্থলনেই সৃষ্টি সম্ভব। শুক্ৰই জীবনী শক্তি। কাজেই সৃষ্টির পথ রোধ করা দরকার। ফলে শক্তি ব্যয় হবে না। আর শক্তি থাকলেই জীবনের ধ্বংস নেই। মূলাধার থেকে তাই শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধে উত্তোলন করে ললাটদেশে সঞ্চিত করে রাখলেই ইচ্ছা শক্তির পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব। এটিই সিদ্ধি। আজকের যুক্তিপ্ৰবণ মনে এর একটি অনুমিত ব্যাখ্যা এ হতে পারে যে এরূপ অস্বাভাবিক জীবনচর্যার ফলে হয়তো এক প্রকার মাদকতা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে আর তাতেই তারা হয়তো মনে করে যে তারা অতি মানবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং আত্মিক অমরত্ব লাভ ঘটেছে।
সাধনার তিনটে স্তর : ১. প্রবর্ত, ২, সাধক ও ৩, সিদ্ধি।
১. প্রবর্তাবস্থায় যোগী সুষুম্নামুখে সঞ্চিত শুক্ররাশি ইড়ামার্গে মস্তিষ্কে চালিত করার চেষ্টা পায়। এতে সাফল্য ঘটলে যোগী প্রেমের করুণারূপ অমৃত ধারায় স্নাত হয়।
২. শৃঙ্গারের রতি স্থির করলে তথা বিন্দু ধারণে সমর্থ হলে যোগী সাধক নামে অভিহিত হয়। তখন মস্তিষ্কে সঞ্চিত শুক্ররাশিকে পিঙ্গলা পথে চালিত করে সুষুম্নমুখে আনে। ফলে বিন্দু আজ্ঞাচক্র থেকে মূলাধার অবধি স্নায়ুপথে জোয়ারের জলের মতো উচ্ছসিত প্রবাহ পায়। এতে প্ৰেমানন্দে দেহ প্লাবিত হয়। এর নাম তারুণ্যামৃতধারায় স্নান।
৩. এর ফলে সাধক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় এবং ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী পথে শুক্র ইচ্ছামত চালু রেখে অজারামরের মতো বোধগত সামরস্যজাত পরমমানন্দ বা সহজানন্দ উপভোগ করতে থাকে। এরই নাম লাবণ্যামৃত পারাবারে স্নান। এতে স্থূল শৃঙ্গারের আনন্দই স্থায়ীভাবে স্বরূপ শৃঙ্গারনন্দ বা সামরস্য লাভ করে। প্রাণায়ামাদি যোগাভ্যাস দ্বারা দেহরূপ দুগ্ধভাণ্ড শৃঙ্গাররূপ মথন দণ্ড সাহায্যে প্রবহমান নবনীতে পরিণত করা হয়। এর ফলে জরা-গ্লানি দূর হয় এবং সজীবতা ও প্ৰফুল্লতা সদা বিরাজ করে।
সূফীমতের উদ্ভব
১
সূফীমতের উদ্ভব সম্বন্ধে বিদ্বানেরা নানামত পোষণ করেন। Von Kremer ও Dozy-এর মতে বেদান্ত প্রভাবেই ইরানে সূফীমতের উন্মেষ হয়। Merix ও Nicholson-এর ধারণা নিউ প্ল্যাটোনিজম থেকেই এর উদ্ভব। E. G, Brown মনে করতেন, বাস্তববাদী শামীয় (Sematic) আরব ধর্ম ইরানের ভাবপ্রবণ আৰ্য মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তা-ই সূফীতত্ত্বেরূপ লাভ করেছে।
কিন্তু মানবমনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অন্ত ঋজুভাবে ঘটে না। কাজেই কোন এক সরল পথে কিংবা কোনো একক মতবাদের প্রভাবে অথবা প্রতিক্রিয়ায় সূফীমত গড়ে উঠেছে বলা যাবে না।
ভাববাদী কৌতুহলী ইরানী মানসে জোরাস্টার, মানী, মজদক, বাইবেল, কোরআন প্রভৃতির বিচিত্র মতবাদ ও তত্ত্ব যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তাতে একদিকে আশারীয়, মোতাজেলা প্রভৃতি মত দেখা দিয়েছে, অপরদিকে ইমাম আবু হানিফ্যাদির নেতৃত্বে কোরআনহাদিসানুগ ধর্মানুশীলনে নিষ্ঠার প্রকাশ ঘটেছে। এর পটভূমিকায় ছিল রাজনৈতিক বিপ্লব। ইরানে স্বাধীন তাহেরি (৮২০ খ্ৰীঃ), সফাবী (৮৬৮ খ্ৰীঃ) ও সাসানী (৮৭৪ খ্ৰীঃ) বংশীয়দের প্রতিপত্তিরও কমবেশী প্রভাব রয়েছে। তবু বলতে হবে শ্ৰীক দর্শনের সাথে পরিচয় ইরানে ভাববিপ্লব ত্বরান্বিত করেছে। এবং একত্ব-প্রবণ ইরানী মনের উদারতার ছিদ্র পথে মুসলিম ইরানী মনে সৰ্বেশ্বরবাদও প্রবেশ করেছিল। সূফী ধর্ম হচ্ছে প্ৰেমবাদ। সে-প্ৰেম আল্লাহ প্ৰেম। সাধ্য আল্লাহ বটে, কিন্তু এর মানবিকতাই প্রেমসাধনার প্রথম পাঠ। সৃষ্টি-প্রেমেই স্রষ্টগ্রেমের বিকাশ : মরণ নদীর এপারে ওপারে ব্যাপ্ত জীবনের নির্ঘন্দ্ব উপলব্ধিতেই এ সাধনার সিদ্ধি। তাই সূফী বলেন, “আত্মবিস্মৃত হয়ে সবাইকে গ্ৰীতি দান কর আর পরের কল্যাণ কর্মে আত্মনিয়োগ কর। মানুষের হৃদয় জয় করাই সবচেয়ে বড় হজ। একটি হৃদয় সহস্ৰ কাবার চেয়েও বেশী; কেননা কা’বা আজার-পুত্র ইব্রাহিমের তৈরী একটি ঘর মাত্র। আর মানুষের হৃদয় হচ্ছে আল্লাহর আবাস।’ সূফীদের ভাববাদে বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদের প্রভাব থাকলেও বৌদ্ধ নির্বাণবোদও ফানাতত্ত্বের উন্মেষের সহায়ক হয়েছে, সে সঙ্গে গুরুবাদও।(১)
তাত্ত্বিক ও মরমীয়া হলেও সূফীরা ইসলামকে ভোলেনি, কোরআনের সমর্থনকেই সম্বল করে জীবন ও ধর্মকে সমন্বিত করবার চেষ্টা করেছে। এতে দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের স্বীকৃতিও সম্ভব করে নিয়েছে এবং তাতেও আবার দোহাই কেড়েছে কোরআনের। ভোগ-পরিমিতিবাদের সূত্র ধরে বৈরাগ্যবাদও প্রশ্ৰয় পেয়েছে। সূফীতত্ত্বে।
মুসলমানদেব সাধারণ বিশ্বাস রসুল ব্যক্তিগত জীবনে তাত্ত্বিক তথা মরমীয়াও ছিলেন। এবং তাঁর প্রিয় সহচর আলি ও আবু বকরকে এই তত্ত্বে দীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি। কোরআনের এক আয়াতে আছে, “যেহেতু আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে রসুল পাঠিয়েছি, যিনি তোমাদের কাছে ওহী পাঠ করেন, তোমাদের দোষ মুক্ত করেন, তোমাদেরকে “কিতাবের শিক্ষা ও প্রজ্ঞা (wisdom) দান করেন এবং যা তোমরা আগে জানতে না, তাই জানিয়ে দেন।”(২)