“উজান উর্ধ্বগতি রতি চলিবে যাহার
সেইজন বেদবিধি হইবেক পার।”
মুসলমানেরাও এই সাধনায় আস্থা রাখে। দেহস্থ প্রাণ ও অপান বায়ু নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা অর্জনই এর লক্ষ্য। “বৌদ্ধ-যোগাচার মতে যেমন কিছুই থাকে না, বিজ্ঞান মাত্র থাকে, সহজমতে তেমনি কিছু থাকে না আনন্দ মাত্র থাকে। এই আনন্দকে তাঁহারা সুখ বলেন, কখনো বা মহাসুখ বলেন। এ সুখ স্ত্রী-পুরুষ সংযোগ জনিত সুখ”।(৩৯) মানুষের লক্ষ্য হচ্ছে ইহলোকে পরলোকে প্রসারিত জীবনে নিরাপত্তা, সুখ-শাস্তি ও আনন্দ-আরাম। পার্থিব জীবনে রমণ-ক্রিয়াতেই মানুষ চরমসুখের আস্বাদ পায়। এ অভিজ্ঞতার ফলেই ‘সামরস্য’ অধ্যাত্ম তথা স্থায়ী মানস সুখের আদৰ্শরূপে গৃহীত হয়েছে। তাই পুরুষ-প্রকৃতি, শিব-শিবানী, মায়া-ব্ৰহ্ম, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতির মৈথুন প্রসূত স্থায়ী সমরসাবস্থাই দিয়েছে চিরন্তন সুখের ধারণা।
এর আর একটি দিকও আছে। সৃষ্টি সম্ভব হয় দেহস্থ শক্তি ব্যয়ে। এই শক্তিই জীবন। কাজেই সৃষ্টি কর্মে নিয়োজিত না হয়ে যদি সংরক্ষিত থাকে, তবে তা স্বাভাবিক ভাবেই আয়ু বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। ‘মরণং বিন্দুপাতেন জীবনং বিন্দু ধারণং।” (শিব সংহিতা)। আবার সৃষ্টি থাকলেই ধ্বংস থাকবে, সৃষ্টির পথ রোধ করলে ধ্বংসের পথও রুদ্ধ হবে–এ ধারণাও তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। প্রজ্ঞা-উপায়, শিব-শক্তি কিংবা রাধা কৃষ্ণের চিরন্তন মৈথুনাবস্থার কল্পনা তথা সহস্রদল পদ্মের উপর পুরুষ-প্রকৃতির সামরস্যের ধারণা এ ভাবেই বিকশিত হয়েছে বলে অনুমান করি। কেননা মোটামুটিভাবে এর ধারাবাহিক ইতিহাস মেলে। সাঁওতাল, হো, পাঞ্চা, কোটার প্রভৃতি সমাজে আজো মৈথুনাচার আদিম আকারেই চালু রয়েছে।(৪০) আবার দার্শনিক তাৎপর্য মণ্ডিত হয়ে উচ্চতর সমাজেও তার কালিক, স্থানিক আর তাত্ত্বিক বিবর্তনও আমরা প্রত্যক্ষ করি। যেমন, শুক্রকে শুভ্ৰ, শুদ্ধ, জ্যোতিষ্মান অমৃত, শিব, চন্দ্র ও ব্ৰহ্ম(৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এবং শুক্র আনন্দ স্বরূপ। তাই শুক্ৰ নিৰ্গমকালে আনন্দ অনুভূত হয়। বৈষ্ণবদের মতেও ‘ধাতুরূপে সর্বদেহে বৈসে কৃষ্ণশক্তি’ (বিবর্তবিলাস)। বৌদ্ধ মতেও ‘হেবজ (বাজসত্ত্ব) নারী যোনিতে শুক্ররূপে বাস করেন’! শুক্র বিনা মহাসুখ লাভ সম্ভব নয়। সেজন্যেই কায়াসাধক বলেন :
নিঅ ঘরিনি জাব ন মজ্জই
তাব কি পঞ্চবশ্ন বিহরিজ্জই।
এণো জপ হোমে মঙ্গল কম্মে
অণু দিন আচ্ছসি বাহিউ ধৰ্ম্মে।
তে বিণু তরুণ নিরন্তর নেহেঁ
বোহি কি লম্ভই এণ বিদেহেঁ।
বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউলদের মধ্যে এ মত আজো অপরিবর্তিত এবং এ সাধনা অব্যাহত রয়েছে :
বাহ্য পরকীয়া এবে শুন ওহে মন
অগ্নিকুণ্ড বিনে নহে দুগ্ধ আবর্তন।
প্রকৃতির সঙ্গে সেই অগ্নিকুণ্ড আছে
অতএব গোস্বামীরা তাহা জপিয়াছে।
…বিষকে অমৃত ভাই যে পারে করিতে
কামরতি বিষ জারি হইবে প্রেমেতে। (বিবর্তবিলাস)
লোকায়ত সমাজে তো এটিই স্থূলরূপে বিদ্যমান ছিল। বাৰ্হস্পত্য সূত্ৰমে আছে : সৰ্বথা লোকায়তিকমের শাস্ত্ৰমর্থ সাধনকালে, কাপালিকমের কাম সাধনে।
মাধবাচাৰ্য বলেন লোকায়তিকরা কামাচারী–অর্থ ও কামসাধনাই তাদের লক্ষ্য।
গুণরত্ন বলেছেন–কাপালিক ও লোকায়তিকে কোন তফাৎ নেই। লোকায়তিকেরা গায়ে ভস্ম মাখে, মদ খায়, মাংস খায় এবং তারা মিথুনাসক্ত ও যোগী। বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে তারা সবাই একস্থানে মিলিত হয়ে মৈথুনে রত হয়।(৪২) সাঁওতালেরা আজো এমনি উৎসব পালন করে।(৪৩) শৈব-শাক্ত বৈষ্ণব ধর্মেরও ভিত্তি হয়েছে এই শুক্ৰ-রজঃ তত্ত্ব।(৪৪)
৯
ক. বৌদ্ধ দেহতত্ত্ব :
দেহ স্থান | কায়/চক্র | পদ্ম | দল | |
১. | নাভি | নির্মাণ | নাভি | ৬৪ |
২. | হৃদয় | ধর্ম | হৃৎ | ৩২ |
৩. | কণ্ঠ | সম্ভোগ | কণ্ঠ | ১৬ |
৪. | মস্তক | সহজ | উষ্ণীষ | ৪ |
বৌদ্ধমতে গ্রাহ্য-গ্ৰাহকের অস্তিত্বহীনতাই শূন্যতা, এই শূন্যতাই নির্বাণ।
খ, হিন্দু দেহতত্ত্ব :
দেহস্থা | চক্র | পদ্মদল | |
১. | গুহ্য ও জনন-ইন্দ্ৰিয়ের মধ্যস্থ | মূলাধার | ৪ |
২. | জনন-ইন্দ্রিয়ের মূলে সুষুম্নার মধ্যস্থ চিত্ৰণী নাড়ী | স্বাধিষ্ঠান | ৬ |
৩. | নাভি মূল | মণিপুর | ১০ |
৪. | বক্ষ | অনাহত | ১২ |
৫. | কণ্ঠ | বিশুদ্ধ | ১৬ |
৬. | ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থল | আজ্ঞাচক্র | ২ |
এর উপরে আছে সহস্রদল পদ্ম। নাম সহস্রার। মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে এখানে পরমশিবের মিলন হয়। কুণ্ডলিনী হচ্ছে সাড়ে তিন চক্র করে থাকা মূলাধারস্থ সৰ্প। এটি বজঃবিষ বা কাম বিষেব প্রতীক। বিষকে অমৃতে পরিণত করে স্থায়ী আনন্দ লাভ করাই সাধ্য।
সাধন প্ৰণালী :(৪৫)
দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ী।। তার মধ্যে তিনটে প্রধান–ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না বা গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী। এ তিনটেকে মহানদী কল্পনা করলে অন্যসব হবে উপনদী বা স্রোতস্বিনী। এগুলো দিয়ে শুক্র, রজঃ, নীর-ক্ষীর রক্ত প্রবহমান। এ প্রবাহ বায়ু চালিত। অতএব, বায়ু নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
আবার শুক্র, রজঃ ও রক্ত হচ্ছে মিশ্রিত বিষামৃত, জীবনী শক্তি ও বিনাশ বীজ, সৃষ্টি ও ধ্বংস, কাম ও প্রেম, রস ও রতি। শ্বাস-প্ৰশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পবনকে নিয়ন্ত্রিত করলে গোটা দেহের উপরই কর্তৃত্ব জন্মায়। প্রশ্বাস হচ্ছে রেচক, শ্বাস হচ্ছে পূরক এবং দম অবরুদ্ধ করে রাখার নাম কুম্ভক। ইড়া নাভিতে পূরক, পিঙ্গলায় রেচক করতে হয়, দাম ধরে রাখার সময়ে দৈর্ঘ্যই সাধকের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ। এর নাম প্ৰাণায়াম। এমনি অবস্থায় দেহ হয়। ইচ্ছাধীন। তখন যে শুক্রের স্থলনে নতুন জীবন সৃষ্টি হয়, সেই শুক্রকে নাড়ী মাধ্যমে উর্ধে সঞ্চালিত করে তার পতন-শ্বলন রোধ করলেই শক্তি হয় সংরক্ষিত। সেই সঞ্চিত শুক্র শরীরে জোয়ারের জলের মতো ইচ্ছানুরূপ প্রবহমান রেখে স্থায়ী রমণ-সুখ অনুভব করাও সম্ভব।