এসব মতের ধারকরা ব্ৰাহ্মণ্যবাদী জৈন ও বৌদ্ধদের কাছে ‘লোকায়তিক’ বলে ঘৃণ্য ছিল, যদিও বেদাদি সব শাস্ত্রগ্রন্থেই আমরা এসব মতের অপরিমেয় প্রভাব লক্ষ্য করি।
মৈথুন মাধ্যমে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা মানুষকে নারী-পুরুষ, তত্ত্বভাবনায় তথা মৈথুনতত্ত্ব কল্পনায় দিয়েছে প্রেরণা। কিন্তু কালে মৈথুনতত্ত্বের আদি উদ্দেশ্যের বিস্মৃতি ঘটেছে এবং এটি নতুন তাৎপর্য পেয়ে অধ্যাত্ম মাধুর্যে মহৎ এবং তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। এর বিচিত্র বিকাশ আমরা জৈন-বৌদ্ধ সমাজে এবং শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-গাণপত্যলিঙ্গায়েতে দেখেছি। আবার এর আদি রূপও নিঃশেষে লোপ পায়নি। তার রেশ রয়েছে। জয়পুর, পাঞ্জাব, নিলগিরি, ছোট নাগপুর, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব বাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে।(২৫)
মৈথুন যেমন আদিতে ফসল উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়েছে, তেমনি আবার রতি বিরোধ সাধনায়ও প্রবর্তনা দিয়েছে। কাজেই বামাচারী ও কামবর্জিত সাধনার উৎস অভিন্ন।(২৬)
বলেছি, সাংখ্য হচ্ছে তত্ত্ব, আর যোগ ও তন্ত্র হচ্ছে সাধনশাস্ত্ৰ। যোগ ও তন্ত্র দুটো ভিন্ন ধারায় যেমন চলেছে, তেমনি আবার যোগ্যতান্ত্রিক মিশ্রধারাও সৃষ্টি করেছে। মুসলমানেরা ধর্মীয় বাধার দরুন তন্ত্রাচার পরিহার করবার চেষ্টায় ছিল। তবু কোন কোন শ্রেণীর সূফী-বাউলে তন্ত্রাচার বিরল ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ সৈয়দ মর্তুজা, আউলচাঁদ, মাধব বিবি প্রমুখ সাধক-সাধিকার নামোল্লেখ করা যায়।
৭
তন্ত্ৰমতে পুরুষ ও প্রকৃতির আদি মৈথুন থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি।(২৭) সাংখ্যেও তাই।(২৮) তন্ত্রের মতোই সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ও আদিম কৃষিকেন্দ্রী যাদুবিশ্বাস থেকেই জন্ম লাভ করেছে।(২৯) সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র মূলত দেহাত্মবাদী ও নাস্তিকমত। যোগে ও তন্ত্রে ঈশ্বর পরবর্তীকালে ঠাঁই করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু এসব সাধনায় ঈশ্বররোপাসনার স্থান অপ্রধান। দেহতত্ত্বই মুখ্য। এই দেহাত্মবাদী নাস্তিক্যমতকে ব্ৰাহ্মণ্যবাদীরা গোড়ার দিকে ‘অসুরমত’ বলে আখ্যাত করেছে।(৩০) গীতায় বলা হয়েছে, অসুর মতে ‘অপরস্পর সম্ভূত কিমান্যং কাম হৈতুকম।’ ১৬।৮ অর্থাৎ জগৎ নারীপুরুষের মিলনাজাত এবং কামোদ্ভূত। একে ব্ৰাহ্মণ্যবাদীরা লোকায়ত মত বলে অবজ্ঞা করেছে। নিঃসন্দেহে আদি অবিমিশ্র তান্ত্রিক, যোগী এবং সাংখ্যমতবাদীরাই লোকায়তিক। তাই শীলাঙ্ক রচিত ‘সূত্ৰকৃতাজ্ঞ সূত্রের ভাষ্যে’ সাংখ্য ও লোকায়তিকে বিশেষ পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি।(৩১) তিন মতই গীতার আমলেও অভিন্ন ছিল।
৮
যোগতান্ত্রিক সাধনতত্ত্ব : একজন বিদ্ধানের ভাষায় সাধন তত্ত্বটি এই ‘যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্ৰহ্মাণ্ডে–ব্ৰহ্মাণ্ডে যে গুণা; সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবারে।’ ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত। … তন্ত্ৰ বলিতেছেন যে যখন ব্ৰহ্মাণ্ড ও দেহভাণ্ড একই পদ্ধতি অনুসারে একই রকমের উপাদান সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একই পদ্ধতির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্ৰহ্মাণ্ডের শক্তি তোমার অনুকুল হইবে।…এদেশের সিদ্ধগণ বলেন যে মনুষ্যদেহের মতন পূর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই… অতএব এই যন্ত্রন্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে অন্য কোন স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পূর্ণ হইতে পারে।(৩২) এখানে বিরোচনের উক্তি স্মর্তব্য : এই পৃথিবীতে দেহের পূজা ও পরিচর্যা করে দেহকে মহীয়ান করলেই দুই লোকে সাফল্য লাভ ঘটে।(৩৩) বাউলের মুখেও পাই এ তত্ত্ব :
সখি গো জন্ম-মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্ৰেমগো চাই
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব সার
তীর্থব্ৰত যার জন্য
এই দেহে তার সব মিলে।
কেননা, “এই দেহতেই কৈলাস, এই দেহতেই হিমালয়, এই দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহতেই গোবর্ধন, এই দেহাভ্যন্তরেই হরগৌরী বা কৃষ্ণ-রাধিকা নানা লীলা-নাট্য প্রকাশ করিতেছেন।”(৩৪)
অতএব, আদি যোগ ও মৈথুনতত্ত্বকে বৌদ্ধ ও ব্ৰাহ্মণ্য মনীষা সূক্ষ্মতর বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে নতুন ধর্মে ও শাস্ত্রে রূপায়িত করে। তাই “সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া সাধনা সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠিত।”(৩৫) “বাঙলা দেশে এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চল সমূহে এই তন্ত্র প্রভাব খ্রীস্টীয় অষ্টম শতক হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া মহাযান বৌদ্ধ ধর্মকে বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করিয়া দিয়াছিল। …বাঙলা দেশে যত হিন্দু তন্ত্র প্রচলিত আছে, তাহা মোটামোটি ভাবে খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতক হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে রচিত।”৩৬) অষ্টাদশ শৈব আগমও গুপ্তযুগে রচিত এবং গুপ্তযুগের শেষের দিকে এবং পালযুগে তান্ত্রিক শক্তির পূজার প্রচলন হয়।(৩৭) “এই তন্ত্ৰ সাধনার একটি বিশেষধারা বৌদ্ধ দোঁহাকোষ এবং চৰ্যাগীতিগুলির ভিতর দিয়া যে সহজিয়ারূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্ৰম-পরিণতি বাঙলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে।…(এবং) সপ্তদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ইহা এখানে একটা নবরূপ লাভ করিয়াছে এবং এই নবরূপেই বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে তাহা গভীর প্রভাবান্বিত করিয়াছে।”।(৩৮) তান্ত্রিক, যোগী, সহজিয়া, বাউল–সবাই দেহচর্চাকেই মূল্যব্রত করেছে। তবে তান্ত্রিক ও সহজিয়ারা রতি-প্রয়োগে এবং নাথাযোগীরা রতিনিরোধে এ সাধনা করে। দুটো যৌগিক প্রক্রিয়া নির্ভর। একটি বামাচারী অপরটি কামবর্জিত। একটি রমণ-ক্রিয়ার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানানুগ সাধনা, অপরটি কেবল বিন্দুধারণ ও উর্ধায়ন প্ৰণালী নির্ভর চর্যা। এর নাম উল্টা সাধনা। হঠযোগ এর অবলম্বন।