বস্তুবাদী এই নাস্তিক্যতত্ত্বের দেশী স্বাধীন বিকাশও লক্ষণীয়। চাৰ্বািক তথা লোকায়ত মতবাদ এই সাংখ্য-যোগ তত্ত্বের আর আচারের বিশেষ বিকাশ, এবং কালিক বিবর্তন আর স্থানিক রূপান্তরও দেখা যায়।(৭)
আবার মুসলমানরাও এই যোগতত্ত্ব এবং সাধন প্রণালী গ্ৰহণ করে সূফী মতের এক বাঙালী তথা ভারতিক রূপান্তর ঘটিয়েছে। কলন্দর ও কবীরই এ ব্যাপারে বিশেষ নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৩
ভেলভেলকার ও রানাডে বলেন “যোগ আদিতে অবৈদিক সাধন পদ্ধতি ছিল এবং আদি যাদুবিশ্বাস তথা sympathetic Magic-এর ধারণাও ছিল এর মূলে।”(৮) A. E. Goughও বলেন–“স্থানীয় অনাৰ্য অধিবাসীদের কাছ থেকেই বৈদেশিক আর্যরা কালক্রমে যোগ সাধন পদ্ধতিটা গ্ৰহণ করেছিল।”(৯) H. Zimmer বলেন “সাংখ্য ও যোগের মূল ধারণাগুলি অত্যন্ত প্রাচীন ও বেদ-পূর্ব যুগের। সাংখ্য ও যোগ জৈনদের যান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত”।(১০)
হরপ্ৰসাদ শাস্ত্রী বলেন ‘কৌটিল্য তিনটি মাত্র দর্শনের উল্লেখ করেন–সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। সাংখ্য মত সকলের চেয়ে পুরান। উহা মানুষের করা এবং পূর্বদেশের মানুষের করা। উহা আৰ্যদের মত নহে; —বঙ্গ বগধ ও চেরজাতির কোন আদি বিদ্বানের মত।… . বৌদ্ধমত সাংখ্যমত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, এ কথা অশ্বঘোষ এক প্রকার বলিয়াই গিয়াছেন। বুদ্ধদেবের গুরু আড়ার কলম, উদ্রক–দুজনেই সাংখ্যমতাবলম্বী ছিলেন।(১১) সি. কুহিলান রাজার মতেও সাংখ্যমত অবৈদিক।(১২)
৪
সাংখ্য দর্শন সম্মত ত্ৰিগুণ (স্বত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) এবং প্রকৃতির অন্ধ প্রবণতা, যোগদর্শন সম্মত ইন্দ্ৰিয় সংযম এবং চিত্তের অভিনিবেশ-এর উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে বিশেষ করে অথর্ববেদে মেলে। কঠ, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক, ছন্দোগ্য ও মৈত্রায়নী উপনিষদে সাংখ্যসম্মত ধারণা লক্ষ্য করা যায়।(১৩) বৃহদারণ্যকে আছে, যে-ব্যক্তি আত্মা ছাড়া অন্য কোন দেবতার আরাধনা করে সে-দেবগণের গৃহপালিত পশু বিশেষ। বৃহদারণ্যকে ও ছান্দোগ্যে চরম কথা ঘোষিত হয়েছে : আত্মাই ব্ৰহ্ম।(১৪)
যোগ ও সাংখ্য মহাভারতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মহাভারতের বিভিন্ন ভাবধারায় প্রাথমিক সাংখ্যের স্বভাববাদী দ্বৈতামত ও প্ৰাথমিক যোগদর্শনের সাধনার অঙ্গস্বরূপ ঈশ্বরবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। গীতায় সাংখ্য ও যোগকে অভিন্ন বলা হয়েছে। যোগ হচ্ছে সাংখ্যেব ব্যবহারিক প্রয়োগ। যোগ ও সাংখ্যের দার্শনিক ভিত্তি একই। পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রে ঈশ্ববরূপ যে একটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, তার জন্যেই এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য।(১৫)
ছান্দোগ্যে বিরোচন বলছেন–‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে। দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক এই উভয়লোকই লাভ করা যায়।’ ৮৮।৪।
৫
তান্ত্রিক আচারগুলোর পূর্বাভাসও বেদে বর্তমান। ঐশীশক্তির স্ত্রীরূপকে উচ্চতর মর্যাদা দান এবং বিষ্ণু আর শিবের শক্তি-মহিমা ও ক্রিয়ার ধারণাও অবৈদিক। আগাম শাস্ত্ৰও অবৈদিক।(১৬) সাংখ্য, যোগ, পাশুপত ও পঞ্চরাত্র যথাক্রমে কপিল, হিরণ্যগৰ্ভ, শিব ও নারায়ণপ্রোক্ত বলে বিশ্বাস করা হয়।(১৭) ছন্দোগ্যে রমণক্রিয়াকে যজ্ঞস্বরূপ এবং আয়ু, পশু (ধান), কীর্তি ও সন্তান লাভের উপায় বলে অভিহিত করা হয়েছে।(১৮) মহাভারতে উদালক ঋষির উক্তিতে আছে, “গাভীগণের মত স্ত্রীগণ শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তারা অধৰ্মলিপ্ত হয় না। (বরং এরূপ আসক্ত হওয়াই) নিত্য ধর্ম”।(১৯) পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তন্ত্র অতি প্ৰাচীন। তন্ত্র ধর্মই বাঙলার আদিম ধর্ম এবং ইহা অবৈদিক ও অনার্য।”(২০) শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতেও তন্ত্র ‘আদিম অনাৰ্য গুপ্ত শাস্ত্ৰ’।(২১)
৬
ব্ৰাহ্মণ্যশাস্ত্ৰে গৃহীত হয়ে যেমন সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রেব মিশ্রীবিকাশ হয়েছিল, তেমনি এদের অবিমিশ্র বিকাশধারাও অব্যাহত ছিল। বরং সে-ধাবাই জৈন-বৌদ্ধযুগে প্ৰবল হয়ে গভীর, ব্যাপক ও স্থায়ী হল।
বৃহস্পতিলৌক্য বা ঋগ্বেদের ব্ৰহ্মণস্পতি সর্বপ্রথম বস্তুকে চরম সত্য বলে ঘোষণা করেন। চার্বাকরা ছিলেন বৃহস্পতির মতানুসারী। এ কারণে তাদেরকে বাৰ্হস্পত্য বা লোকায়তিক বলা হয়। এরা বস্তুবাদী-অধ্যাত্মবাদী হয়, বেদের আমল থেকে অব্যাহত রয়েছে এদের ধারা। তার আগেও যে লোকমনে এর জড় ছিল, তা অনুমান করা যায়, বেদে এ মতের উল্লেখ দেখে। রামায়ণের জাবালিমুনি, হরি বংশের রাজা বেণ, গৌতম বুদ্ধের সমকালীন অজিত কেশ কম্বলী, তাঁর শিষ্য পায়াসি, আর ভাগুরি, পুরন্দর প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে নাস্তিক্যবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন।(২২) এ ধারার চিন্তার প্রসূন হচ্ছে ইন্দ্ৰিয়াত্মবাদ, প্ৰাণাত্মবাদ ও মনশ্চৈতন্যবাদ। দেহের বিনাশে চৈতন্য লুপ্ত হয় এবং দেহের উপাদানগুলো নিজ নিজ ভূতে মিশে যায়, কাজেই কর্মফল ভোগ, আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ ইত্যাদি অর্থহীন। ‘জড় পদার্থ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি’–এই মত বৃহদারণ্যক উপনিষদেও মেলে এবং দেহাত্মবাদের ইঙ্গিত পাই ছন্দোগ্যের ইন্দ্ৰ-বিরোচন উপাখ্যানে।(২৩)
‘ব্ৰহ্মজাল সূত্ত’ মতে বৈদিক কর্মকাণ্ডে বিরোধী সম্প্রদায় ছিল বহু ও বিবিধ। এ সময়ে বিভিন্নপন্থী তীৰ্থিকগণ (নাস্তিক আচাৰ্য) পুরাণ কস্সপ, মকখলি, গোসাল, অজিতকেশকম্বলী প্রভৃতি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তথা ‘আজিবক’রা ব্ৰাহ্মণ্যমতবাদ বিরোধী প্রচারণা চালাতেন।(২৪)