ভারত উপমহাদেশ সূফী ধারায় প্রভাবিত হওয়ার পূর্ব থেকেই সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ হতে থাকে এবং খ্রিষ্টীয় একাদশ শতক থেকেই এই উপমহাদেশে সূফীমত প্ৰবেশ করে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চলে সাধারণত: ইসলাম প্রচার করেন। সূফী-দরবেশগণ। যেহেতু অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর; সেহেতু পূৰ্বপুরুষের ধর্ম, দর্শন, সংস্কার ত্যাগ করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই অশিক্ষার দরুণ সূফী সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানরা শরীয়তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পাবেনি। এই কারণেই তারা সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে, সেখানেই অংশগ্রহণ করেছে। বৌদ্ধ নাথপন্থা, সহজিয়াতান্ত্রিক সাধনা, শক্তিতন্ত্র, যোগ প্রভৃতি এমনি করে তাদের আকৃষ্ট করেছে এবং এভাবেই মিশ্ৰ-দৰ্শনের উদ্ভব ঘটেছে।
পরিশেষে প্রাসঙ্গিকক্রমে বলতে হচ্ছে যে, ‘বাঙলার সূফী সাহিত্য’ প্রথমে ১৯৬৯ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব থাকার কারণে দু-তিন দশক পূর্বেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায় এবং বিষয়ের গুরুত্ব ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমী বিগত ৩৩ বছরেও গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সঙ্গতকারণেই বাঙলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে অন্যতম রুচীিশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘সময় প্রকাশন” বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে আলোচ্য গ্ৰন্থটি পুনর্মুদ্রণের জন্য আগ্রহ প্ৰকাশ করাতে এর সত্ত্বাধিকারী জনাব ফরিদ আহমেদ-এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এছাড়া আমার অজ্ঞতা ও ব্যস্ততার কারণে পাণ্ডুলিপির সর্বশেষ প্রািফ কপি দেখে দিয়েছেন আমার সুহৃদ, গবেষক ড. ইসরাইল খান। গ্ৰন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে জনাব মাহমুদ করিম-এর উৎসাহ ও এডভোকেট যাহেদ করিম-এর সহযোগিতা লাভ করেছি। গ্ৰন্থ প্রকাশের শুত-মুহুর্তে তাদের সকলকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
ড. নেহাল করিম
অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা –বাঙলার সূফী-সাধনা ও সূফী-সাহিত্য
১
বাঙলাদেশে সূফীতত্ত্ব ও সূফী সাধনা একটি স্থানিক রূপ লাভ করেছিল। বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদ বা অদ্বৈততত্ত্ব ও যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবই এর মুখ্য কারণ। অবশ্য মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধমত ও বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রভাবে সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে গুরুবাদী, বৈরাগ্য-প্রবণ ও দেহচৰ্যায় উৎসুক কিছু সাধকের আবির্ভাব বারো শতকের আগেই সম্ভব হয়েছিল। ইরান ও বলখ অঞ্চলের ভাবপ্রবণ লোকমনে বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদের প্রভাবও পরোক্ষ মানসক্ষেত্র রচনায় সহায়তা করেছিল বলে মনে করি।
তাই ভারতে যে-সব সূফী সাধক প্রবেশ করেন, ভারতিক অধ্যাত্মতত্ত্ব ও সাধনার প্রভাব এড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁদের কাছে দীক্ষিত দেশী জনগণও পূর্ব-ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত অদ্বৈতচেতনা ও যোগগ্ৰীতি ত্যাগ করতে পারেনি। বিশেষ করে বিলুপ্ত বৌদ্ধ সমাজের ‘যৌগিক-কায়-সাধন’ তত্ত্ব তখনো জনচিত্তে অম্লান ছিল। ফলে “সূফীমতের ইসলাম সহজেই এদেশের প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করে নিতে সমর্থ হয়েছিল।”(১) একই কারণে ও পরিবেশে পরবর্তীকালে সূফীবাদের সামঞ্জস্য হয়ে সহজিয়া ও বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।(২)
ব্ৰাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্ৰমত। এর আধুনিক নাম নাথপন্থ। ‘অমৃতকুণ্ড’ সম্ভবত এদেরই শাস্ত্র ও চর্যগ্রন্থ। এটি গোরক্ষ-পন্থীর রচনা বলে অনুমিত হয়।(৩)
বামাচার নয়–কায়সাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনই এদের লক্ষ্য। ‘হঠ’ যোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। এক সময় এই নাথপন্থ ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়, চর্যাগীতি ও নাথসাহিত্য তার প্রমাণ। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলামে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম আর বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে চলে, এরই ফলে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত বাউল মতের উদ্ভব। অন্যদিকে অদ্বৈতবাদ ও যোগ পদ্ধতিকে সূফীরা নিজদের মতের অসমন্বিত অঙ্গ করে নিয়ে যোগতত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। এর ফলে মুসলিম সমাজে ও সাহিত্যে যোগের ও যোগসাধনার ব্যাপক প্রভাব ও চর্চা লক্ষ্য করি।
এখানে আমরা এই যোগ-সাহিত্যেরই পরিচয় নেব। এর জন্যে কিছু পূর্বকথার অবতারণা প্রয়োজন।
২
সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র সুপ্রাচীন দেশী তত্ত্ব ও শাস্ত্ৰ। Pagan যুগের যাদুবিশ্বাস ও টোটেম স্তরের মৈথুন তত্ত্ব থেকে এর উদ্ভব।(৪) সাংখ্য হচ্ছে তত্ত্ব বা দৰ্শন আর যোগ ও তন্ত্র-এর দ্বিবিধ আচার শাস্ত্ৰ।(৫) এসব তত্ত্ব ও আচারের জড় রয়েছে আদিম মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিন্তায় ও কর্মে।
অতএব, মূলত এক অভিন্ন তত্ত্ব শাস্ত্ৰই কালে দুই নামে দুই রূপে বিকশিত হয়েছে। প্রভাব হয়েছিল গভীর, ব্যাপক এবং কালজয়ী। বহিরাগত দ্রাবিড়, আৰ্য এবং উত্তর কালের মুসলিম–এদের কেউ অবহেলা করতে পারেনি এসব, বরং গোড়া থেকেই এর প্রভাবে পড়েছিল সবাই এবং নিজেদের ধর্মমত ও আচারের অসমন্বিত অঙ্গ করে নিয়ে যোগ্যতত্ত্বে বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকে।(৬)