মন থির তো বচন থির
পবন থির তো বিন্দু থির
বিন্দু থির তো কন্ধ থির
বলে গোরখদেব সকল থির।(২৯)
ডক্টর সুকুমার সেন ঋথেদের নাসদীয় সূক্তে এবং বৃহদারণ্যকে(৩০) ধৰ্মপন্থী ও নাথপন্থীদের মতবাদের জড় আছে বলে বিশ্বাস করেন।
মহাভারতের শল্য পর্বের যোগীর কাহিনী কিংবা বিদুর, ব্যাসদেব, বিপুল, নারদ, সনৎকুমার প্রমুখের কাহিনীতেও যোগীজীবনের আভাস রয়েছে। চর্যাকার ঢেণ্টন, সরহ প্রভৃতির গানের প্রতিধ্বনি ও আদল মিলে কবীর, কুতবন, মালিক মুহম্মদ জয়সী, দাদু ও গোরখপন্থীদের রচনায়। কৃষ্ণ দাসের ‘ভক্তমালে’ মীননাথ-গোরক্ষনাথও ঠাঁই পেয়েছেন। কাজেই নাথপন্থের প্রসার হয়েছিল ভারতময়। নাথদের অমরত্বের স্বরূপ এই :
‘মূঢ় লোকে দৃষ্ট (বস্তু) নষ্ট হল দেখে কাতর হয়
তরঙ্গ ভঙ্গ কি সাগরে শোষে
মূঢ় অবস্থায় লোকের দৃষ্টি খোলে না।
(যেমন) দুধের মাঝে মাখন থাকে, কিন্তু কেউ দেখে না
এই সংসারে কেউ আসে না, যায়ও না
এই ভাব নিয়ে বিলাস করছেন যোগী কাহ্ন।’(৩১)
এই ধারার রূপান্তর পাই যোগীকাচে। উত্তর বঙ্গের হিন্দু-মুসলমান যোগীকাচের তত্ত্বে লক্ষ্য রেখেই দেহসাধন করে। কেবল যে বৌদ্ধশাস্ত্ৰেই এই কায়াসাধন তথা দেহতত্ত্ব বা যোগসাধনা আছে তা নয়। জৈন শাস্ত্ৰেও পাই। যেমন অবহটঠে দেখি :
প্রশ্ন :
কালহিঁ পবনহিঁ রবিসসিহিঁ
চউ একটঠই বসু
হউঁ তুহিঁ পুচ্ছউঁ জোইয়া
পহিলে কাসুবিনাসু?
উত্তর :
সসি পোষই রবি পজ্জলই
পবন হলোলে লেই
সত্ত রজ্জু তমু পিল্লি করি
কৰ্ম্মহঁ কালু গিলেই।(৩২)
জৈন ধর্মের আদি প্রবর্তন বলে পরিচিতি ‘ঋষভ’ও জৈনশাস্ত্ৰে আদিনাথরুপে অভিহিত। ইনি বৃষধ্বজ এবং নিবাস কৈলাসে। নাথদের আদিনাথ শিব, অতএব জৈনদের আদিনাথও সম্ভবত শিব-ই। মহাবীরও নিগন্থনাথ (>নিগ্রন্থ>বেদবিরোধী)। ইনি জ্ঞাতিগোত্রীয় বলে নাথ পুত্ত (জ্ঞানি>ঞাতি>নাত, পুত্ৰ>পুত্ত) নামেও পরিচিত।
যোগীদের হঠযোগ প্রক্রিয়া আর তান্ত্রিকদের ভূতশক্তি মূলত অভিন্ন। দুটোই যৌগিক প্রক্রিয়া। কাজেই ভারতিক কোনো সাধনাই যোগবিহীন নয়। হঠযোগই কায়াসাধনের প্রকৃষ্ট উপায় : হ = (সূৰ্য>অগ্নি) ও ঠ>(চন্দ্ৰ> সোম) যথাক্রমে শুক্র ও রজঃ-এর প্রতীক। প্রথমটি ভোক্তা, দ্বিতীয়টি উপভোগ্য। দুটোর মিলনেই সৃষ্টি সম্ভব।(৩৩)
এগারো শতকের জৈন প্রাকৃতে সিদ্ধ হেমচন্দ্রের লেখা ‘কুমারপাল চরিত’-এর টীকায় দেহতত্ত্ব সম্পর্কিত পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।(৩৪) বাঙলা-বিহারের এক শ্রেণীর লোক ‘শবাক’ নামে পরিচিত। ‘শরাক’ ‘শ্রাবক’-এর বিকৃতি হওয়াও অসম্ভব নয।(৩৫)
৫
‘প্ৰাণ সঙ্কলি’ নামে সৃষ্টিপত্তন ও মানব জন্ম রহস্য রয়েছে। শূন্যপুরাণে, ধর্মপূজাবিধানে, যোগীব গানে, যোগীকাচে, ধর্মঠাকুবের পূজা-পদ্ধতিতে (৩৬ মুসলিম রচিত ‘গোরক্ষাবিজয়’ ‘আগম’ ‘মোকামমঞ্জিল’ ‘আদ্য পরিচয়’ প্রভৃতি গ্রন্থেও ‘প্ৰাণ সঙ্কলি’ দেখি। এটি যোগ গ্রন্থের অপরিহার্য অঙ্গ। কায়াসম্ভেদ’-এ আছে :
প্ৰথম মাসেতে গর্ভে বর্ণ যে যব প্ৰমাণ
দ্বিতীয় মাসেতে গর্ভে বিন্দু বর্ণ আন।
তৃতীয় মাসেতে গর্ভে বিন্দু রক্ত গোলা
চতুর্থ মাসেতে বিন্দু স্থানে স্থানে স্থানা।
পঞ্চম মাসেতে গর্ভে বিন্দু অতি বড় সুখ
ষষ্ঠম মাসেতে গর্ভে বিন্দু অতি বড় দুখ।
সপ্তম মাসেতে গর্ভে বিন্দু সপ্ত ঋতু বসন্তি
অষ্টম মাসেতে গর্ভে বিন্দু গতাগতি।
অষ্ট অঙ্গে জোড় নয় মাসে
গর্ভে বিন্দু উপবায়ু পবন আকাশে
নয় মাসে নির্মল মুরতি
দশ মাসে দশদিক মূরতি।(৩৭)
শেখ জাহিদের ‘আদ্য পরিচয়ে’ও বর্ণিত হয়েছে এমনি গর্ভরহস্য। ধর্মঠাকুর পন্থীদের প্রভাবও পড়েছে। এ গ্রন্থে।
এর ‘প্ৰস্তাবনা’ ও ‘সৃষ্টি পত্তন’ অংশ এখানে উদ্ধৃত হল :
গৰ্ভতন্ত্র যোগতন্ত্র সিদ্ধের কাহিনী
বুঝিলে মুকতি হয় শুনিতে মধুর বাণী।
আউটি বিচার যেবা জানিব নিশ্চয়
জ্ঞান কর্মেতে তাকে সন্দেহ নাহি রয়।
জ্ঞান জনিব যেবা করিব ধেয়ান
ধ্যান না কৈলে তার কিবা গেয়ান।
দান ধ্যান যেবা করএ সমরস
যোগতন্ত্র সিদ্ধাতন্ত্র রাখে। সব হএ বশ।
লোহ মোহ কাম ক্ৰোধ কিছু করিতে না পারে
আপনি অনুগ্রহ তারে করেন করতারে।
গর্ভের বিচার জানিলে বাড়িব রঙ্গ
যেমতে সৃষ্ট হয় মনুষ্যের অঙ্গ।
মায়ের যতেক দ্রব্য পিতার যত ধন
অনাদ্য ধর্মের যত বয়স রতন।
স্বৰ্গ মৰ্ত্য পাতাল কহিমু স্থানে স্থানে
বাত, বরুণ, আনল বেশে যে যেইখানে।
চন্দ্ৰ সূৰ্য আকাশে যত তারা সাজে
তুলনা দিমু সব শরীরের মাঝে।
নদ নদী আর গঙ্গা ভাগীরথী
শরীরের মাঝে ঢেউ বহিছে দিবারাতি।
কিঞ্চিৎ কহিমু তাহা শুরুর উপদেশ
তাহার প্রসাদে মুঞি জানিলুঁ বিশেষ।
আদ্য অনাদ্য গুরু কহিল শ্ৰবণে
সেই হইতে মোর জনমিল জ্ঞানে।
কহিল সকল কথা হৃদয়ে উতরি
কিঞ্চিৎ কহিমু সেই কথা অনুসারি।
ব্ৰহ্মার আনন যত রাবণের করে
গুনিলে যত হয় সহস্ৰ উপরে।
এত শাকের মাঝে করিল প্রচার
পয়ার প্রবন্ধে কহি আত্মা বিচার।
জাহিদে কহে চিত্তে করি আছোঁ সার
সুহৃদ চরণ বিনে গতি নাঞি আর।
বাঙলার মুসলমান সূফীদের লক্ষ্য, সাধ্য ও সাধনা এরূপই ছিল। জাহিদ বর্ণিত সৃষ্টি তত্ত্ব :
না ছিল ক্ষিতি জল ই মহি মণ্ডল
শূন্য মধ্যে না ছিল প্ৰকাশ।
স্বৰ্গ মর্ত্য পাতাল সব ছিল অন্ধকার
আউর না ছিল আকাশ।
চন্দ্ৰ সূৰ্য তারা না ছিল অভিপরা(?)
না ছিল নবীন জলধার
বাউ বরুণ আনল পৃথিবী রসাতল
না ছিল পর্বত শিখর।
নদনদী শূন্যাকার না ছিল পাড় ঝঙ্কার
না ছিল সাগর তিখ স্থান
সংসারে না ছিল কিছু সব হৈল তার পিছু
সবেমাত্র ছিল ভগবান।
এক ছিল নিজরূপ কিছু না পাইল সুখ
ভাবিলা প্ৰভু আপন শরীরে
শূন্যাকার ঘুচাই দৃষ্ট রচিলাত নানা সৃষ্ট
এক খেলা খেলাব সংসারে।
আপনার দিরা৷রতি নিজে লয়ে এক মূর্তি
রাখিল গোসাঞি অলঙ্ঘ্য সাগরে।
মিত্ত সঙ্গে অ্যালাপনে কৌতুক বাড়িল মনে
নিৰ্মাইল একটি হুঙ্কারে।
সৃজন করিয়া মিত্ত হরিষ বাড়িল চিত্ত
জলের উৎপত্তি হইল সংসাবে।
শীঘ্র কহিতে বচন তাহাতে জনিল পবন
আনল জন্মিল ক্ৰোধ হৈতে।
মিত্তের অঙ্গে মলি নিজ কবে তাহা তুলি
যোগাইল জলের উপরে
মিত্তিকা বাড়য়ে জলে সমুদ্রের উৎতালে
দিনে দিনে হয় প্রসারে।
জনিল চাবি রত্ন পাইয়া মহা রত্ন
শ্রধাএ সৃজিল গোসাঞি
সংসারেত জন্মে সব হয় ক্রমে ক্রমে
ওহি বহি অন্য কিছু নাঞি।
যত ছিল ভয়ঙ্কর সব হইল প্রচার
ওঙ্কারে করিল নির্মাণ
রচিল তিন জীব তাহাতে দিয়া শিব
সৈন্য মুখ্য কৈল স্থানে স্থান।
জন্মিল দেব অসুর বলে হইল প্রচুর
বাহু বলে না চিনে অন্যথা
নিরবধি করে রণ না জানে মরণ
কাহো সনে নাহিক মমতা।
ঘোড়া হস্তী প্রখর রাক্ষস ভয়ঙ্কর
রাজত্ব করে চিরকাল
ভুঞ্জিল আপন মনে বিধির বিধানে না চিনে
কেবা সৃজিল সয়াল।
প্ৰভু করিল মনে আমা কেহো নাহি চিনে
কি কারণে করিলুঁ প্ৰকাশ
ক্ৰোধ হইয়া দেও সব করিল খও
যে কে কে কৈল বংশ নাশ।
নির্মূল করিয়া দেও সংসারে নাঞি কেও
এমন গেল কত দিবস
পুনর্বার করিল মনে মনুষ্য সৃজোঁ ভুবনে
তাহা হৈতে পাইমু হরিষ।
তাহাক করিমু রাজা জীবেরে করিমু প্ৰজা
পৃথিবী সৃজিয়া দিব মহীতলে।
করিমু প্ৰবীণ পূজে যেন রাত্রিদিন
তেয়াগিয়া সকল জঞ্জালে।
আর কথা সৃজিল কাহাত সুখ না পাইল
মনুষ্য করিমু সৃজন
আপনার অঙ্গ ছিল আর কথা নিৰ্মাইল
কেমন মনুষ্য আকার হয়।
সেবক জাহেদ কএ শুন গুরু মহোশএ
শতে শীতে প্ৰণতি আমার।
ভাবিয়া চরণ তোমার লিখিব আমি পয়ার
যেমতে হএ মনুষ্য আকার।
এরপরে গর্ভে শিশুর গঠন বর্ণিত হয়েছে।