পিরীতি উলটারীতি না বুঝে চতুরে,
যে না চিনে উল্টা সে না জিয়ে সংসারে।
সমুখ বিমুখ হয়ে বিমুখ সমুখ
পাল্টা নিয়মে সব জগত সংযোগ।
বিমুখে আগম পন্থে রাখিছে গোপতে
চলিলে বিমুখ পন্থে সিদ্ধি সর্বমতে।
সমুখের সব পন্থ বিমুখ করিয়া,
পলটি বিমুখ পন্থে যাইব চলিয়া।(১৭)
গোরক্ষ বিজয়ে পাই ‘ষঠচক্ৰ ভেদ গুরু খেলাউক উজান’।(১৮) এরই নাম উল্টা সাধনা।
৩
শিব ও উমা প্রাচীন অনাৰ্য দেবতা। ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মে ও সমাজে তারা গোড়া থেকেই প্রাধান্য পান। বৌদ্ধ বিলুপ্তির যুগে শিবগৌরী যোগাচারী বৌদ্ধদের আদিনাথ ও তারার স্থান গ্ৰহণ করে। এরূপে নাথপন্থ ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের উপশাখা রূপে পরিচিত হতে থাকে। আদিনাথও আদি যোগী। যোগীশিব ও চৌরাশী সিদ্ধার যে ঐতিহ্য রয়েছে(১৯) তাতেই বোঝা যায়, এই যোগী ধর্মের বিস্তৃতি ছিল তিব্বত থেকে আসাম-বাঙলা-বিহার ও উড়িষ্যা অবধি। গুজরাট, পাঞ্জাব, রাজপুতনা থেকে উত্তর বঙ্গ অবধি নিরঞ্জন-পন্থী যে-সব যোগী-সন্ন্যাসী কানফটা, মাচ্ছেন্দ্রী বা মছলন্দী, কানিপা প্রভৃতি নামে পরিচিত(২০), তারাও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ যোগী। জ্যোতিরীশ্বরের ‘বর্ণরত্নাকরে (১৪শ শতক) চৌরাশী সিদ্ধার(২১) উল্লেখ আছে। বলেছি মহাদেব ও গৌরীকে কেন্দ্র করে নাথন্থ নতুন করে উৎসারিত হয়েছে :
আদ্যে গুরু মহাদেব পিছে আর সব
সাধন্ত সকল সিধা তরিবারে ভব।
শিবের ডাহিনে বামে হাড়িফা মিনাই
পৃষ্ঠ ভাগে গৌরী আছে জগতের মাই।।(২২)
নানা কারণে “বঙ্গ-কামরূপে” নাথ মতের বিশেষ বিকাশ হয়েছিল :
হাড়িফা পূর্বেতে গেল দক্ষিণে কানফাই
পশ্চিমোতে গোৰ্থ গেল উত্তরে মিনাই।(২৩)
হাড়িফা ওরফে জালন্ধরী পা’র আদি নিবাস নাকি সিন্ধু দেশে। তিনি পাটিকের রাজ্যভুক্ত জ্বালন ধারা(২৪) তথা আধুনিক চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাস করতেন বলে জালন্ধরী নামে পরিচিত। এবং সেখানে গোবিন্দ চন্দ্র রাজার আমলে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন বলে হাড়িফা নামেও হলেন প্ৰখ্যাত। কাহ্নপাদ বা কানুপা ছিলেন সম্ভবত দক্ষিণ বঙ্গ কিংবা উড়িষ্যায়। তিনিও এসেছিলেন শুরু হাড়িফার উদ্ধারার্থ জ্বালান-ধারায়।(২৫) গোরক্ষনাথের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল গোটা উত্তর ভারতেই। আজো গোরখানাখী সম্প্রদায়ের প্রভাব অম্লান। মীননাথের প্রভাবও সমভাবে পড়েছিল তিববত থেকে বাঙলা-আসাম অবধি। কামরূপ অঞ্চলে কদলী নগর ও মেলে।
৪
ধর্মমঙ্গল-শূন্যপুরাণের ধর্মঠাকুর আর নাথ-ঐতিহ্যের নিরঞ্জন-আদিনাথ অভিন্ন। এবং ধর্ম ঠাকুরের পুরাণ কথা আর নিরঞ্জনের সৃষ্টি বর্ণনা একই।(২৬) যেমন :
নাথপন্থীদের সাধ্য হচ্ছে ‘মহাজ্ঞান’। এই মহাজ্ঞান লাভ করলে যৌগিক সাধনা বলে মানুষ হয় অমর। বৌদ্ধ চিন্তার জরা-মৃত্যু জয় করে আত্মিক বাঁচার সাধনা করাই তাদের ব্ৰত।
শিবের থেকে দুর্গ মহাজ্ঞান লাভ করলে, দুর্গা স্বয়ং ও দুর্গার প্রভাবে গোটা সৃষ্টি অমর হবে,–দ্বিজলক্ষ্মণের ‘অনিল-পুরাণে” এ তত্ত্ব হেঁয়ালী রূপে বৰ্ণিত হয়েছে। এ হেঁয়ালী আমরা চর্যাপদ ও দোহার কাল থেকে পাচ্ছি :
যতেক জ্ঞান কথা শিব দুর্গাকে কহিব
সকল সংসার দুৰ্গা অমর করিব।
ধর্মের পরামর্শে উলুক দুর্গাকে মায়ানিদ্রায় অভিভূত করল, আর মীননাথ দুর্গার হয়ে ‘হুঁ’ ‘হুঁ’করে সব তত্ত্ব জেনে নিল। মহাজ্ঞান লাভের ফলে :
শুনিয়া পরম সত্য পাকা চুল হৈল কাঁচা
সরুতমা সংকীর্ণ নিলে ধরিছে উজান
অক্ষয় অমর দেখা পদ নির্বাণ।
বলেছি প্রজ্ঞা-উপায় ও আদিনাথ-আদ্যাশক্তি এবং ধর্মঠাকুর, ধর্ম নিরঞ্জন-কেতকার স্থলে বৌদ্ধ বিলুপ্তির কালে ব্ৰাহ্মণ্য প্রভাবে শিব-শক্তিই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধদের উপাস্য হয়ে উঠেন।(২৮)
শিব-গৌরী ও মহাজ্ঞানতত্ত্ব থেকে একদিকে গোরক্ষনাথ-মীননাথ কাহিনীর বিকাশ অপরদিকে হাড়িফা-কানুকা তথা ময়নামতী-গোবিন্দ চন্দ্র গাথার উৎপত্তি। প্রথমটিতে শিষ্য বিকৃত-বুদ্ধি গুরুকে চৈতন্য দান করেছেন। দ্বিতীয়টিতে মাতা পুত্ৰকে বৈরাগ্য অবলম্বনে প্রবর্তনা দিচ্ছেন। প্রথম কাহিনী পাই গোরক্ষাবিজয়ে ও মীন চেতনে, দ্বিতীয় কাহিনী মিলে ময়নামতীগোপীচাঁদের গাথায়। অপর কাহিনী রূপ পেয়েছে ধর্ম নিরঞ্জন তত্ত্বভিত্তিক হয়ে শূন্যপুরাণে, ধর্মপূজাবিধানে, অনিলপুরাণে ও ধর্মমঙ্গলে। এর একটি শাখার বিকাশ ঘটেছে চর্যাপদে বৈষ্ণব সহজিয়ায় ও বাউল গানে। এ সবগুলোই বৌদ্ধ অবলুপ্তির পরে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সম্পপ্রদায়ের ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের প্রচ্ছায় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়াস প্রসূত। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় এই গোরক্ষনাথমীননাথ কাহিনীর তত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশুদ্ধ যোগীর নাথপন্থ। আর হাড়িফ-কানুফার তত্ত্ব ভিত্তি করে রূপ নিয়েছে বামাচারী তান্ত্রিক সাধনা যার ফলে গড়ে উঠেছে সহজিয়া মতবাদী গৃহযোগী সম্প্রদায়। নাথ পন্থীরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত; এঁরা অবধূত যোগী। আর ফা’–পন্থীরা নানা তান্ত্রিক উপসম্প্রদায়ভুক্ত–এঁরা কাপালিক যোগী। নাথপন্থীদের মূল সাধ্য সংযম, চিত্তস্থৈৰ্য, বিন্দুধারণ ও আত্মজ্ঞান লাভ। কালজয়, ব্ৰহ্মচৰ্য, জ্ঞানযোগ ও ভাণ্ডে ব্ৰহ্মাণ্ড দর্শন তাদের ব্ৰত। শিব তাদের আদিগুরু–তাই শৈব হিসেবে তাদের পরিচয়। সহজাবস্থা বা সহজানন্দ লাভে অদ্বৈত সিদ্ধি ঘটে, ফলে ভাণ্ড-ব্ৰহ্মাণ্ড, মর-অমর, বাস্তব-স্বপ্ন একাকার হয়ে যায়। হঠযোগ (চন্দ্র + সূৰ্য) মাধ্যমে উল্টা সাধনায় বীৰ্য উৰ্ধগ, বায়ুনিরুদ্ধ ও চিত্তনিস্ক্রিয় হলেই শিব-শক্তির সামরস্য ঘটে। কেননা,